নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন দামে নাকাল জনজীবন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে ভোজ্যতেলের দাম আকাশচুম্বী। আলোচনার শীর্ষে রয়েছে সয়াবিন তেল। এবার জনগণের ভোগান্তিতে যুক্ত হলো বিভিন্ন ধরনের ডাল। বাজারে সব ধরনের ডালের দাম বাড়তি। নীরবেই বেড়ে চলছে পণ্যটির দাম। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
তথ্য বলছে, তিন থেকে চার মাসের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। ছোলার দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে ১০ টাকা। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, মসুর ডাল কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকা। হাইব্রিড মাঝারি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। মুগ ডালের কেজি ১৩০ থেকে ১৫০, খেসারি ৮০-৮৫ টাকা এবং অ্যাঙ্কর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। অন্যদিকে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, দেশে উৎপাদিত ডালের মৌসুম শেষদিকে। আর আমদানি করা বেশিরভাগ ডালই বিক্রি হয়ে যাওয়ায় আমদানিকারকরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী শরিফ হোসেন বলেন, গত তিন দিনে পাইকারিতে মসুর ডালের দাম বস্তায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ কারণে খুচরা বাজারে ডালের দাম বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে আমদানি করা বড় মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা কেজিতে। এ ডাল এক সময় ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির সর্বশেষ তথ্যমতে, আমদানি করা বড় দানার মসুর ডালের দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৪৪ শতাংশ, মাঝারি দানার মসুর ৪১ এবং দেশি বা ছোট দানার মসুর ডালের দাম ১২ শতাংশ। মুগ ডালের দাম বেড়েছে ২ শতাংশ। অ্যাঙ্কর ডালের দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ। তবে বছরের ব্যবধানে ছোলার দাম না বাড়লেও গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এদিকে মসুর ডালের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত চার মাসে দুই দফায় কেজিতে পাঁচ টাকা করে মোট ১০ টাকা বাড়িয়েছে টিসিবি। ৩ নভেম্বর পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৫৫ টাকা থেকে ৬০ এবং ৩ ফেব্রুয়ারি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা করা হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ডালজাতীয় ফসলের মোট উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৬৪ হাজার টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় এক লাখ ৩৩ হাজার টন ডাল কমে উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ ৩১ হাজার ২১০ টন। এর মধ্যে খেসারি ডাল উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ ৯৬ হাজার ৯৮১ টন, মসুর ডাল দুই লাখ ৫৮ হাজার ৪৬২ টন এবং মুগ ডাল দুই লাখ ৫২ হাজার ২৬৭ টন আর ছোলা উৎপাদন হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৭৬ টন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ডালের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ লাখ দুই হাজার ৮৭ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর সব ধরনের ডাল মিলিয়ে মোট চাহিদা প্রায় ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে গড়ে উৎপাদন ৯ থেকে ১০ লাখ টন। ফলে প্রতি বছর প্রায় ৬০ শতাংশ ডালের ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতি পূরণে ১৭ লাখ টনের মতো ডাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, বছরে ডালের চাহিদা রয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টন। শুধুমাত্র মসুর ডালেরই চাহিদা রয়েছে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন। আর ছোলার চাহিদা রয়েছে ১০ থেকে ১৫ লাখ টন। এ চাহিদার অর্ধেকই লাগে রমজানে। ফলে এই সময় দামে কিছুটা হেরফের দেখা যায়।
ছোলার দাম বাড়েনি দাবি করে বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি নাসের উদ্দিন খান বলেন, আট থেকে ১০ বছর ধরে প্রায় একই দাম রয়েছে। ডালের কোনো সংকট নেই। বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় দেশে তিন গুণের মতো ছোলা মজুত রয়েছে। তিনি বলেন, এক সময় সিরিয়া, তুরস্ক ও ভারত থেকে ডাল আমদানি করা হলেও এখন আর সেসব দেশ থেকে আমদানি হয় না।
নাসের উদ্দিন আরো বলেন, বর্তমানে দেশে যেসব ডাল পাওয়া যায় সেগুলো অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা থেকে আমদানি করা। এর মধ্যে খুব সংকট দেখা দিলে মিয়ানমার থেকেও কিছু ডাল আমদানি করা হয়।বাংলাদেশ পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ বলেন, গত বছরের আমদানি করা ছোলা এখনও মজুত আছে। তাছাড়া রমজান উপলক্ষে নতুন করে ছোলার ডাল আমদানি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ছোলার মজুত পর্যাপ্ত রয়েছে। দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বরে ডাল আমদানি বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ। অর্থবছরের এক হাজার কোটি টাকার বেশি ডাল আমদানি করা হয়। আগের বছরের এ সময় ১০ কোটি ডলারের ডাল আমদানি করা হয়।
আনন্দবাজার/শহক