দেশের ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির হয়ে ওঠায় লাগাম টেনে ধরতে চেষ্টা করছে সরকার। ইতোমধ্যে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে এখনই ভোজ্যতেলের দাম কমে আসবে বলে মনে করছেন না ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আমদানিকারকদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ হয় ভোজ্যতেলের বাজার।
বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লে আমদানিকারকরাও দেশে দাম বাড়িয়ে দেন। ভোজ্যতেলের প্রধান আমদানিকারক দেশীয় ছয় প্রতিষ্ঠান হলো- সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বসুন্ধরা ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি। এসব কোম্পনি বিদেশ থেকে ভোজ্য তেল আমদানি করে থাকে।
সূত্রমতে, বিদেশ থেকে আমদানি করা সয়াবিন তেল চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছা পর্যন্ত সবমিলিয়ে খরচ পড়ে প্রতি লিটারে ১২৭ টাকা। বন্দর থেকে বের হওয়ার পর সাধারণ ক্রেতার কাছে পৌঁছা অবধি সেই সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১৯০ টাকা পর্যন্ত। বিক্রেতারা বলছেন, বেশি দামে কেনার কারণেই তাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। মূলত আমদানিকারকদের পরের ধাপেই দাম বেড়ে যায় ভোজ্যতেলের। তবে সরকারের কড়াকড়ির কারণে গত শুক্রবার থেকে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকায় মিলছে বলে অনেক ক্রেতা তথ্য দিচ্ছেন।
বিশ্ব বাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য অনুসারে, গত ডিসেম্বরে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল এক হাজার ৪১১ ডলার। ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি টনে জাহাজ ভাড়া পড়ে ৭০ ডলার। সব খরচ মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার পর প্রতি টন সয়াবিন তেলের মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৪৮১ ডলার বা এক লাখ ২৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। এই হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম পড়ে ১২৭ টাকা ৩৬ পয়সা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর ভোক্তার হাত পর্যন্ত যেতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে যোগ হতে পারে আরও ২৫ থেকে ২৭ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে রিফাইনিং খরচ, ভ্যাট, এআইটি, ইন্সুরেন্স ব্যয়। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের লাভের অংশটি যোগ করার পর খোলাবাজারে প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম বড়জোর হতে পারে ১৫৩ টাকা।
কিন্তু বাস্তবে মাত্র কয়েকদিন আগেও প্রতি লিটার সয়াবিন কিনতে ক্রেতার পকেট থেকে গেছে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা। অথচ টিসিবির ট্রাকে সেই একই সয়াবিন মিলছে প্রতি লিটার মাত্র ১১০ টাকায়। এভাবে এই এক সয়াবিন নিয়েই চলছে তুমুল উত্তেজনা। এর মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সরকারের হস্তক্ষেপে গত শুক্রবার থেকে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকাতেই পাওয়া গেছে। এর আগে সয়াবিন তেলের ওপর শতকরা ১৫ ভাগ ভ্যাটও প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি তেল বিক্রিতে পাকা রসিদের নিয়ম চালু হয়েছে।
গত চার বছরে যে কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, সয়াবিন ও পাম অয়েল তার মধ্যে শীর্ষে। ২০১৯ সালে দেশের বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১০৪ টাকা। মাত্র এক বছর পর ২০২০ সালে সেটি বেড়ে হয় ১১৩ টাকা, ২০২১ সালে ১৩০ টাকা এবং ২০২২ সালের শুরুতে এসে হয় ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকা। গত শুক্রবারের আগ পর্যন্ত চলছিল ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা। অন্যদিকে পামঅয়েলের লিটার (খোলা) ২০১৯ সালে ছিল ৫৮ টাকা, ২০২০ সালে লিটারে ৭৮ টাকা, ২০২১ সালে ১০৭ টাকা এবং ২০২২ সালের শুরুতে হয় ১৫০ টাকা। আর এখন চলছে ১৬৫ টাকা।
দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। অথচ ২০২১ সালে ২৭ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হওয়ার পরও বাজারে এখন সয়াবিন তেল স্বাভাবিক মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে না। আমদানিকারকরাই নির্দিষ্ট ডিলারদের দিয়ে সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুত করার ফলে সংকট হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক