ঢাকা | সোমবার
৩০শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৫ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

২৩ গ্রামে সবজি বিপ্লব

২৩ গ্রামে সবজি বিপ্লব
  • সোনাফলা রূপগঞ্জ
  • মৌসুমে ৫ কোটি টাকার বাণিজ্য

যেদিকে চোখ যায়, শুধু সবজি আর সবজি। চারদিক যেন সবুজের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ সেখানকার চাষিরা এখন কীটনাশকবিহীন সবজি চাষ করছেন। চাষ করছেন নানা ধরনের ফসলের। রূপগঞ্জের ২৩ গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টরে সবজি চাষ করে বদলে দিয়েছে দৃশ্যপট। প্রতি মৌসুমে প্রায় ৫ কোটি টাকার সবজি বিক্রি হয় ঢাকাসহ সারাদেশে। এখান থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার সবজি চলতি মৌসুমে বিদেশ রফতানি হয়েছে। এ এলাকাগুলোকে মানুষ ‘সবজির গ্রাম’ বলেই চেনে।

সবজি চাষের এলাকা : রূপগঞ্জ উপজেলার রূপগঞ্জ সদর ও দাউদপুর ইউনিয়ন। এ দুই ইউনিয়নে সোনাফলে। এখানকার ২৩ গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক পরিবার সবজি চাষ করে পাল্টে দিয়েছে রূপগঞ্জের দৃশ্যপট। সবজি চাষ করে এসব গ্রামের সবাই এখন স্বাবলম্বী। রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চাপরি, গোবিন্দপুর, কামতা, হারারবাড়ি, পরশি, কুমারটেক, কুচিলাগর, সুলপিনা, আলমপুর, ইয়াপুরা ও দাউদপুর ইউনিয়নের কালনি, জিন্দা, ধামচি, হিরনাল, বৈলদা, কুলপ, বিরহাটাবো, বাগলা, তীরমারা, আমদিয়া, পলখান, বেলুন, গলানসহ প্রায় ২৩ গ্রামের হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি সবজির আবাদ করে এখন স্বচ্ছল জীবনযাপন করছে। সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছর চাষির সংখ্যা বাড়ছে। এসব এলাকায় লাউ, কাকরোল, চিচিঙ্গা, করলা, শিম, বরবটি, শসা, কচু, ধুন্দুল, জিঙ্গা, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজির চাষ হয়।

শসা চাষ করে স্বচ্ছল প্রান্তিক চাষিরা : শসার আবাদ করে রূপগঞ্জের দাউদপুরের চাপরি, বাতান, কুচিলাগর, বৈলদা ও কুলপ এলাকার শত শত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি এখন স্বচ্ছল জীবনযাপন করছে। শসা চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই চাষীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। চলতি মৌসুমে এসব গ্রাম থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার শসা রফতানি হবে বলে কৃষকরা আশা করছেন। প্রতিদিন বিকালে পাইকাররা এসব এলাকা থেকে শসা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। চাষি ওমেদ আলী, ফটিকসহ আরো অনেকেই জানান, শসা উৎপাদন করে চাষিদের বিক্রির জন্য কোনো চিন্তাই করতে হয় না। ফড়িয়ারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে শসা কিনে নিয়ে যায়। আর তারাই আবার পাইকারদের কাছে বিক্রি করে। প্রতি গ্রামেই অসংখ্য ফড়িয়া রয়েছে। আছে পাইকারও। প্রতিদিন এখানে এক হাজার মণ শসা বেচাকেনা হচ্ছে। দুপুরের পর থেকেই গ্রামাঞ্চলের রাস্তার ধারে এবং মহাসড়কে শসার হাট বসে। সন্ধ্যা নাগাদ বেচাকেনা শেষ হয়। প্রতিরাতেই ট্রাকযোগে শসা ঢাকা নেয়া হয়।

সরজমিনে চাপরি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের শতকরা ৯৫ ভাগ চাষি এখন শসার চাষ করেন। চাপরি গ্রামের শসাচাষি শিরিষচন্দ্র জানান, শসা চাষ খুবই লাভজনক। আটহাজার টাকা খরচ করে এক বিঘা জমিতে শসার আবাদ করলে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। তার নিজের ২ বিঘা জমি রয়েছে। পুরো জমিতেই তিনি শসা চাষ করেন। একই গ্রামের কৃষক আব্দুর বারেক অন্যদের দেখাদেখি জমি বর্গা নিয়ে শসার আবাদ করে স্বচ্ছল হয়েছেন। স্থানীয় সবজির পাইকার আনোয়ার আলী জানান, প্রতিদিন ২ থেকে ৩ ট্রাকযোগে কম করে ৮শ’ থেকে ১ হাজার মণ শসা ঢাকায় চালান করা হচ্ছে ।

কচু ফলছে কুচিলায় : কুচিলায় যে প্রচুর কচু ফলে তা গ্রামের নাম দেখেই বোঝা যায়। গ্রামের অশীতিপর বৃদ্ধ মান্নান ব্যাপারি জানান, বাপ দাদারে দেখছি কচু ফলাইতে তাই আমরাও করছি। এটি সিজনাল সবজি হলেও তা বর্তমানে সারা বছরই ফলছে। এক বিঘা জমিতে প্রায় ৩ হাজার পিস কচু ফলে। কৃষক রমজান হোসেন বলেন, লাল মাটির কচু খাইতে স্বাদ আছে। আমগো বেচাও ভালাই অয়।

বেলুন গ্রামের মানুষ বেগুনের গুনে স্বাবলম্বী : গ্রামের নাম বেলুন। এ গ্রামটি বেগুন উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। বেগুন চাষ করে এ গ্রামের মানুষ এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। এ গ্রামের বেগুন মাখনের মতো মোলায়েম, প্রায় বিচিবিহীন আর মনোগ্রাহী গন্ধযুক্ত হওয়ায় ভোজন রসিকদের রসনাসিক্ত করতে জুড়ি নেই বলে সারা দেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ সুযোগ স্থানীয় চাষিরাও দেদার আবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। কৃষক রামকমল, গাজী আনোয়ার জানান, বেলে দো-আশ মাটিতে বেগুন ভাল হয়। তবে বেগুন চাষের জন্য গোবর, সার ও ছাইয়ের বিশেষ প্রয়োজন। বেগুন চাষী মতিউর রহমান জানান, প্রতি বিঘা জমিতে বেগুন চাস করলে তাদের ৫ হাজার টাকা করচ হয় আর বেগুন বিক্রি করলে ঐ জমি থেকে তারা পায় ২৫ হাজার টাকা।

ইছাপুরা ও কালনির বৃহত্তর তরকারির হাট : রূপগঞ্জের ইছাপুরায় বসে সবজির হাট। প্রতিদিনই বসে এ হাট। সবজির জন্য বিখ্যাত রূপগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা হরেকরকম তরিতরকারি নিয়ে নিয়ে এ হাটে আসেন। ভ্যান কিংবা রিক্সা যোগে যত রকম তরকারি আছে তা গ্রাম থেকে ভোরবেলায় ইছাপুরা বাজারে আনা হয়। ক্রেতারও ভোর বেলা ট্রাক নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে অপেক্ষায় থাকেন। পছন্দসই তরকারি কিনে তা বস্তা কিংবা ডালায় ভরে ট্রাকে লোড করে থাকেন। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ধুমধাম চলে তরকারি কেনাবেচা। হাটের ইজারাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ,প্রতিদিন এখানে প্রায় ২ হাজার মন তরকারি কেনাবেচা হয়। ঢাকার সিংহভাগ সবজির চাহিদা মিটানো হয় ইছাপুরা ও কালনি হাটের আসা সবজি দিয়ে।

রূপগঞ্জের সবজি রফতানি হয় বিদেশে : সবজি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে. রূপগঞ্জ ও দাউদপুর ইউনিয়নের ২৩ গ্রামে যে সবজি চাষ হয় তাতে সামান্যতম কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। ফরোমন ট্রাপ ব্যবহার করে এ এলাকার সবজি চাষ হয়। ফলে পোকামাকড়ের আক্রমন থেকে রেহাই পাওয়া যায় বলে কৃকষরা বলেন। রূপগঞ্জের সবজি এখন বিদেশ রফতানি হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে রফতানিকারকরা সরাসরি মাঠ থেকে কীটনাশকবিহীন সবজি তুলে নিয়ে যান। উপজেলা কৃষি অফিসার ফাতেমা নূর বলেন, সত্যিই রূপগঞ্জ সবজির গ্রাম। সম্পূর্ন কীটনাশকবিহীন সবজি ফলে এ এলাকাগুলোতে। সরকারীভাবে সহযোগীতা পেলে তারা আরো ভালো করতো।

সংবাদটি শেয়ার করুন