ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রডের দামে ইতিহাস

রডের দামে ইতিহাস

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে রডের দাম লাগামহীন। প্রতিদিনই উচ্চহারে দাম বাড়ায় সরকারি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ বন্ধের উপক্রম। নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধির মধ্যেই রডের দামের উলম্ফনে চরম বেকায়দায় ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও সাধারণ মানুষ।

নির্মাণখাতের সবচেয়ে জরুরি উপকরণ হিসেবে ব্যাপক চাহিদার রডের দাম এবার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। আর্ন্তজাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে প্রায় ছয় মাস ধরে দাম একনাগারে বেড়েই যাচ্ছিল। সেই অজুহাতের ওপর এবার ভর করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। চলমান যুদ্ধের মধ্যে রডের দাম একেবারেই লাগামহীন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই উচ্চহারে রডের দাম বেড়ে চলায় সরকারি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ বন্ধের উপক্রম হয়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধির মধ্যে রডের দামের উলম্ফনে চরম বেকায়দায় পড়েছেন ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও সাধারণ মানুষ।

সূত্রমতে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন গ্রেডের রডের দাম টনপ্রতি বেড়েছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত। ভালো মানের প্রতিটন রড এখন ৮৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা দেশের ইতিহাসে রেকর্ড। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বেড়ে যাওয়ায় লোহার দাম এখন আকাশচুম্বী বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপ প্রতিটনে ৮০ ডলার বেড়ে বর্তমানে ৬৫০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। সেইসঙ্গে আগে থেকেই বাড়তি জাহাজভাড়া তো আছেই। তাই রডের দাম এখন নাগালের বাইরে। কোনোভাবেই কমার কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বর্ষাকাল এলেই নির্মাণকাজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই এই সময়টাতেই বেশি নির্মাণকাজ চলে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু রড নয়, পাথর, সিমেন্ট, ইট, বিটুমিনসহ সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রির দামই বেড়ে গেছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই মুহূর্তে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে। ভালো আবহাওয়ায় সরকারের উন্নয়ন কাজগুলো বর্তমানে ৯০ শতাংশ হারে চলার কথা থাকলেও নির্মাণসামগ্রীর বাড়তি দরে সে কাজের গতিধারা একেবারেই ২৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে।

চট্টগ্রাম নগরির নির্মানসামগ্রী বিক্রয় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ২ নম্বর গেইট, নাসিরাবাদ, একে খানসহ বেশকিছু এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিটন রডে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেড়েছে। নগরের নির্মাণসামগ্রীর দোকানগুলোতে বিক্রি হয় ৭৫, ৬০ ও ৪০ গ্রেডের রড। সপ্তাহ খানেক আগেও ৭৯ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া ৭৫ গ্রেডের রড এখন ৮৫ থেকে ৮৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি ৬০ গ্রেড রড এখন ছয় হাজার টাকা বেড়ে ৭৩ হাজার টাকা ও ৪০ গ্রেডের রডে পাঁচ হাজার টাকা বেড়ে ৭১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে নগরের দুই নম্বর গেইটের ইসলাম ট্রেডার্সের মালিক ইদ্রিস মিয়া দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, উৎপাদন পর্যায়ে দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবে খুচরা পর্যায়েও দাম বেড়ে যায়। প্রতিদিন আমাদের একটাই প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে, রডের দাম এতো বেশি কেন? কাঁচামালের দাম বাড়ায় কারখানাগুলো বাড়তি দরে রড বিক্রি করছে। এখানে তো আর আমাদের হাত নেই।

একেখান এলাকার শাহ আলম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী শাহ আলম ভূঁইয়া দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, রডের এমন বাড়তি দাম দেখে শুধু ক্রেতা নয়, আমরাও রীতিমত অবাক হয়েছি। কোম্পানির লোকজন বলেছে, যুদ্ধের প্রভাবে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। সে সঙ্গে রডের সরবরাহও তুলনামূলক কমে গেছে। তাই দাম বাড়তি।

এদিকে শুধু ব্যবসায়ী বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানই নয়, রডসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষও। নগরের আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা আবু হাসনাইন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, গেল বছরের শুরুতে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছি। দোতলা পর্যন্ত কাজ করে এখন বন্ধ রেখেছি। একদিকে প্রতিমাসে ব্যাংক লোন চলছে, অন্যদিকে রডসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর দামও বাড়তি। দাম কমলে কাজে হাত দিব সবসময় এমনটা ভাবি। কিন্তু সে সুযোগ পাই না। বরং দিনকে দিন দাম বাড়ছেই।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম এলজিইডি ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মহিউদ্দীন সেফুল দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রামে সরকারের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান আছে। তবে কাজের গতি একদম কমে গেছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে এখন পুরোদমে আমাদের কাজ চলার কথা। যেহেতু বৃষ্টি নেই। যেখানে এখন ৯০ শতাংশ কাজ চলার কথা সেখানে গতি নেমে প্রায় ২৫ শতাংশে এসেছে।

মহিউদ্দিন সেফুল আরো বলেন, টনপ্রতি ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া রড এখন ৮৫ থেকে ৮৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে কাজের গতিতে ভাটা পড়েছে। তবে শুধু যে রডের দাম, তা নয়, একাধারে সিমেন্ট, পাথর, বালু, বিটুমিন সবকিছুর দাম বেড়েছে। প্রতিটন পাথরে এক হাজার ৮শ টাকা বেড়ে ৫ হাজার টাকা, প্রতি হাজার ইটে ৪ হাজার টাকা বেড়ে ৯ হাজার ও প্রতি ড্রাম বিটুমিনে সাড়ে তিন হাজার টাকা বেড়ে বর্তমানে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে আমাদের প্রায় তিন হাজারের বেশি ঠিকাদার বিপাকে পড়েছেন।

রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের ডিরেক্টর (করপোরেট) সামশুল হক দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, রডের দাম বাড়ার একটাই কারণ, তা হলো বিশ্ববাজারে প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপের বাড়তি দাম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কবে এ শঙ্কা কাটবে তাও বলা যাচ্ছে না। আমরা পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছি। বাড়তি দাম দিয়ে কাঁচামাল কিনে আবার বাড়তি জাহাজ ভাড়া গুণতে হচ্ছে। তাই রডের দাম বেড়েছে।

বাড়তি রডের দামে মুখ থুবড়ে পড়েছে চট্টগ্রামের আবাসন খাতও। আবাসনখাত সংশ্লিষ্টরা অনেকেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখেছেন। আবার কেউ খুব ধীর গতিতে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আবদুল কৈয়্যুম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে যা পরিস্থিতি চলছে নিঃশেষ হয়ে যেতে আমাদের তো আর বেশিদিন সময় লাগবে না। আমরা ক্রেতাদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়েছি। অথচ এখন রডের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় আমাদের নির্মাণ খরচও বেড়ে গেছে। কিন্তু আমরা তো ক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিচ্ছি না। প্রতিটন রড ৭০ বা ৭১ হাজার টাকায় দীর্ঘদিন ধরে বিক্রি হয়েছে। তা বেড়ে এখন ৮৪ থেকে ৮৫ হাজার টনে বিক্রি হচ্ছে। এটা মেনে নেয়া মুশকিল। তাই আমরা রিহ্যাবের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার উদ্যোগ নিয়েছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায় সেজন্য অপেক্ষা করছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন