আগুনে ঘি ঢালছে যুক্তরাষ্ট্র, পাল্টা হুংকার রাশিয়ার
- রাশিয়ার তেল-গ্যাস না পেলে ইউরোপ অচল
- ইতোমধ্যে গমের দাম ১৪ বছরে সর্বোচ্চ
- বাংলাদেশের গমের বাজারও টালমাটাল
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কাজে গালিয়ে একতরফা রাশিয়ার ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা দিতে মরিয়া হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র। নর্থ অ্যাটলান্টিন ট্রেড অর্গানাইজেশন-ন্যাটোকে সামনে রেখে এ পথে পা বাড়াতে যাচ্ছে বিশ্ব মোড়ল (যুক্তরাষ্ট্র)। তাদের দেশে জ্বালানির ৩ ভাগ তেল রাশিয়া থেকে কেনা হয়ে থাকে। এটির ওপরই নিষেধাজ্ঞা দিতে চাচ্ছে দেশটির নেতৃত্বাধীন জোট। তবে রাশিয়াও পাল্টা হুমকি ছুঁড়েছে।
রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এ পথে হাঁটলে তারাও ইউরোপে তেল ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। ফলে ইউরোপকে বরফে ঠাণ্ডা হয়ে মরতে হবে। তাদের বাণিজ্য হয়ে পড়বে স্থবির। অর্থনীতির চাকা যাবে থমকে। কেননা ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস ও ৩০ শতাংশ তেল রাশিয়া থেকেই আমদানি করা হয়। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের মোড়লত্ব দেখাতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় তবে তাদেরও এই কাজ করতে হবে। আর ইউরোপের হাতে এত অল্প সময়ে এই বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সংগ্রহ করাও সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ আরোপের বিষয়ে গত সোমবার আলোচনার এক পর্যায়ে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেল প্রতি ১৩৯ ডলারে পৌঁছেছে। যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর যুক্তরাজ্যে পেট্রোলের গড় দাম লিটার প্রতি রেকর্ড ১৫৫ পেনিতে পৌঁছেছে। নোভাক বলেন, ইতোমধ্যে তেলের আগুনে টগবগ করছে বিশ্ব। এখন নতুন করে যদি রাশিয়ার ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় তবে সেই তেলের গরমে বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। ব্যারেল (এক ব্যারেল সমান ৪২ ইউএস গ্যালন, যা প্রায় ১৫৯ লিটার বা ৩৫ ইম্পেরিয়াল গ্যালন) প্রতি ৩০০ মার্কিন ডলালে পৌঁছাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের শীর্ষ প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশও রাশিয়া। ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে দেশটির অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। সুতরাং, জ্বালানি খাতে যেকোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তা রাশিয়ার অর্থনীতিকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিশ্বের মোট গ্যাস উৎপাদনের ১২.২ শতাংশ করে রাশিয়া, আর রপ্তানিতে দ্বিতীয়। দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সরবরাহ কমেছে এবং চাহিদা বেড়েছে। নোভাক বলেন, একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমাদেরও আছে এবং আমরা নর্ড স্ট্রিম ১ গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা দেবো। তবে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস সোমবার (৭ মার্চ) এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে।
এদিকে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দমিত্রি পেসকোভ রয়টার্সকে বলেছেন, ইউক্রেন যদি লড়াই বন্ধ করে সংবিধান সংশোধন করার পাশাপাশি নিজেদের নিরপেক্ষ ঘোষণা করে এবং রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিভুক্তি ও রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রদেশগুলোর স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে মস্কো এই অভিযান স্থগিত করবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ১১ দিনের মাথায় বৈশ্বিক গমের বাজার ১৪ বছরের সর্বোচ্চ দামে পৌঁছেছে। এর জেরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে বেড়ে গেছে ময়দা এবং নিত্যদিনের খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে ময়দার তৈরি বেকারি আইটেমগুলোর দাম।
গত ৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন যখন জানালেন, বাইডেন প্রশাসন এবং মিত্ররা রাশিয়ার তেল সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবার ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। তারপরেই ফ্রান্স এবং জার্মানির প্রধান পুঁজিবাজারে দিনের শুরুতে চার শতাংশ পতন হয়, আর যুক্তরাজ্যের ফাইনান্সিয়াল টাইমস স্টক এক্সচেঞ্জ বা এফটিএসই সূচকের পতন হয় দুই শতাংশের বেশি। এশিয়ার পুঁজিবাজারেও পতন হয়েছে। স্বর্ণের বাজার, যুদ্ধ বা সংকটের সময় বিনিয়োগকারীরা যা সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করেন, আউন্স প্রতি তার দাম দুই হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। প্রায় ১৮ মাস পর স্বর্ণের দাম এত বাড়লো।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা ছিল সেনাবাহিনীর ওপর। এখন তারা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিশানা বানাবে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোরোদিমির জেলেনস্কি। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের কটাক্ষ করে আক্ষেপের সুরে বলেছেন শুধু অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে রাশিয়াকে থামানো যাবে না।
এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মনে করেন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলে তা হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল।
তিনি হুশিয়ারি দিয়ে রবিবার বলেন, ইউক্রেনের আকাশসীমার উপরে বিমান চলাচল বন্ধ বা ‘ নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা দিলে সেটিকে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কেউ যদি এমন করে তবে তাকে শত্রু হিসেবেই জবাব দেয়া হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও অংশীদারেরা ইতোমধ্যে পুতিনের শাসনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। এ ছাড়া তারা কার্যকরভাবে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইজারল্যান্ড তার ব্যাংকে গচ্ছিত অন্য দেশের অর্থ সাধারণত জব্দ করে না। কিন্তু সেই দেশও রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করে মস্কোর ওপর নতুন আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় অংশ নেবে বলে ঘোষণা দেয়।
তা ছাড়া বিভিন্ন আন্তঃদেশীয় কোম্পানি রাশিয়াতে কার্যক্রম বন্ধ অথবা সীমিত করেছে। গত শনিবার স্যামসাং, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভিসা, মাস্টারকার্ড, পেপ্যাল এবং পোশাক বিক্রেতা কোম্পানি জারা রাশিয়াতে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। কৃষ্ণ সাগরের জলপথে রাশিয়ান জাহাজ চলাচল বন্ধ করা হয়েছে, ইউরোপিয় ইউনিয়নও তাদের আকাশসীমা দেশটির জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে দেশটিতে ব্যবসা পরিচালনা করা কিছুটা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার সব ব্যাংকের বাদ পড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে রপ্তানিকারকদের জন্য পণ্যের মূল্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বিশ্বের খাদ্যশস্যের অন্যতম চার রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন, রাশিয়া, কাজাখস্তান ও রোমানিয়া। বিশ্বের ৬০ ভাগ সূর্যমুখী তেল রপ্তানি হয় ইউক্রেন থেকে। শুধু তেল নয় খাদ্যশস্য রপ্তানিতে বিশ্বের চতুর্থ থাকা দেশটির ওপর গম, ভুট্টাসহ খাদ্যসামগ্রীর জন্য নির্ভরশীল বিভিন্ন দেশ। বিশ্বের ৩০ শতাংশ গম ২০ শতাংশ ভুট্টা রপ্তানি হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। গম, ভুট্টা দিয়ে শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে প্রাণিজখাদ্য উৎপাদন হয়। সূর্যমুখী তেল রপ্তানির ৮০ শতাংশই করে এ দুই দেশ। ইউক্রেন-রাশিয়ার এই যুদ্ধ তেল, গ্যাস, খাদ্যসামগ্রীসহ সকল দিক দিয়েই বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।
বাংলাদেশ: এ তো গেলো বিশ্বের কথা। বাংলাদেশেও যুদ্ধ শুরুর পরপরই সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কায় বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত দশ দিনে প্রতি মণে (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ১২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে গমের দাম। তার জেরে বেড়ে গেছে আটা-ময়দা ও সুজির দামও। এখন দুই কেজি আটার প্যাকেটের খুচরা মূল্য ৯০ টাকা থেকে বেড়ে বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। স্লাইসড রুটির প্যাকেটের দাম ইতিমধ্যেই কিছু ব্র্যান্ডেড বেকারির আউটলেট ও খুচরা দোকানে অন্তত ১০ টাকা বেড়েছে।
দেশে গমের বার্ষিক উৎপাদন ১০-১১ লাখ টন। গত বছর গমের চাহিদা ছিল ৫৪ লাখ টন। মোট চাহিদার চার-পঞ্চমাংশ পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। বাংলাদেশের আমদানির প্রায় ৩৮ শতাংশ আসে যুদ্ধরত বৈশ্বিক রুটির বাস্কেট রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ভারত থেকে গম আমদানি বাড়লেও এই প্রধান দুটি উৎসের অভাব পূরণ অসম্ভব। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রতি বুশেলে (২৭ দশমিক ২১ কেজি) খাদ্যশস্যটির দাম বেড়েছে ১২ ডলার, অর্থাৎ ৪০ শতাংশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গম আমদানিকারক। দেশে বার্ষিক গমের চাহিদা ৫৮ লাখ টন। এর ৬০ শতাংশ মেটানো হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানির মাধ্যমে।
চলতি বছরের ১ মার্চ পর্যন্ত গম আমদানি করা হয়েছে ৩৭ টনের বেশি। গত দুই মাসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। গত বছর দেশ দুটি থেকে গম আমদানি হয়েছিল ৩৫ লাখ টন।