ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পারমাণবিক আগ্রাসী নীতি

পারমাণবিক আগ্রাসী নীতি

উল্টোপথে বিশ্ব—

  • ৯ দেশে মজুদ ১৩৪০০ পারমাণবিক বোমা
  • পৃথিবী ধ্বংসে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া

বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে। রুশ আগ্রাসনের ফলে কী হচ্ছে তা জানতে সবাই উদগ্রীব। পশ্চিমাদের একের পর এর নিষেধাজ্ঞায় জ্বালানির বিশ্ব বাজারে এরইমধ্যে আগুন লেগেছে। তাছাড়া বৈশ্বিক কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা চরম ঝুঁকিতে পড়েছে এ যুদ্ধের প্রভাবে। অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক।

সব কিছু ছাপিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এরই মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বহরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেয়ার পরই বিশ্বে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হলেও এবারই বিশ্ব পারমাণবিক শঙ্কায় পড়লো বলে মনে করা হচ্ছে।

যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিনের এ পদক্ষেপ হয়তো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ইচ্ছার আভাস নয়। বরং ইউক্রেইনের বিষয়ে অন্য দেশগুলোকে নাক না গলানোর জন্য পুতিন এই সতর্কবার্তা দিয়ে থাকতে পারেন। তবে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তাহলে সেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হবে এবং সেটি হবে ধ্বংসাত্মক।

কতটা ধ্বংসাত্মক হবে

হিরোসিমা-নাগাসাকি পৃথিবীর মানুষের কাছে নৃশংসতম বর্বরতার একটি প্রতিচ্ছবি হিসাবে বছরের পর বছর ধরে চিত্রিত হয়ে আসছে। পারমাণবিক বোমার নাম শুনলেই ভয়ে আতঙ্কে ওঠে শান্তিপ্রিয় মানুষের মন। আমেরিকা ‘লিটল বয়’ নামের পরমাণু বোমায় কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মৃত্যুবরণ করেছিল জাপানোর হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরের লক্ষাধিক মানুষ। সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছিল আরো লক্ষাধিক মানুষ। মৃত্যুবরণ করেছিল লক্ষাধিক পশুপাখি ও মৎসজগত। তেজষ্ক্রিয়তায় যুগ যুগ ধরে সেখানকার মানুষ, জীবজন্তু নানা ধরনের ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। কত মানুষ এবং প্রাণি যে বিকলাঙ্গ হিসাবে জন্মগ্রহন করেছে তা হিসাবের বাইরে।

হামলার ৭৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও বিশ্ববাসী এখনো পারমাণবিক বোমা হামলার হুমকি এবং আশংকা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। লিটল বয়ের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা দেখে শিউরে ওঠা পৃথিবীর বুকে এখন লিটল বয়ের চেয়েও শক্তিশালী সংস্করণের বোমা রয়েছে। টেলিগ্রাফের এক গবেষণানুসারে ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ভাণ্ডারে থাকা বোমার মিলিত শক্তি প্রায় ৬,৬০০ মেগাটনের সমান। যা প্রতি মিনিটে সূর্য থেকে পৃথিবীতে আগত সৌরশক্তির দশ ভাগের এক ভাগের সমতুল্য।

‘আর্থস ফিউচার’ নামক বৈজ্ঞানিক গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত ২০১৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১০০টি পারমাণবিক অস্ত্রের ডেটোনেশন সমৃদ্ধ আঞ্চলিক যুদ্ধেই তৈরি হবে মোট ৫ টেট্রাগ্রাম ব্ল্যাক শুট (৫,০০০,০০০,০০০ কেজি)। যা কি না পৃথিবীর স্ট্রাটোস্ফিয়ার স্তর অব্দি পৌঁছে গিয়ে সূর্যালোকের আগমন বন্ধ করে দেবে। প্রায় ৮০ বছর ধরে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বিশ্বের হাতে। অনেক দেশই নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় এটিকে প্রতিরোধক হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।

ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্ট-এর মতে, রাশিয়ার কাছে ৫ হাজার ৯৭৭টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। যার মধ্যে চার হাজার বা বেশিরভাগকে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র বিবেচনা করা হয়। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট, যেগুলো অনেক দূর থেকে বিস্ফোরণ ঘটানো যাবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বর্তমানে রাশিয়ার দেড় হাজার ওয়ারহেড ‘মোতায়েন’ আছে। অর্থাৎ এগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমার ঘাঁটি অথবা সমুদ্রে সাবমেরিনে রয়েছে।

সবচেয়ে বড় বোমা

নিউকম্যাপ ওয়েবসাইটের মতে, বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী কার্যকরী পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রটি হচ্ছে বি-৮৩। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসম্ভারে থাকা সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বোমা এটি। এটি নিক্ষেপের প্রথম ২৪ ঘণ্টায়ই ১৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। পাশাপাশি অতিরিক্ত ৩৭ লাখ মানুষকে আহত করবে। যার তাপীয় তেজষ্ক্রিয়তার ব্যাসার্ধ দাঁড়াবে ১৩ কিলোমিটারে।

যার রয়েছে হিরোশিমা ধ্বংসকারী বোমা ‘লিটল বয়’ থেকেও ২০০ গুণ বেশি ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। আর সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাটির ব্যাপ্তি হবে ১৪.৯ বর্গ কিলোমিটার। এটা বিস্ফোরিত হলে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকা সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। তৎক্ষণাৎ পুরোপুরি অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দৃষ্টিসীমার সবকিছুই আড়াল হয়ে যাবে।

রাশিয়ার পরমাণু নীতি

রাশিয়ার পারমাণবিক নীতিতে পারমাণবিক অস্ত্র শুধু প্রতিরোধ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। এগুলো ব্যবহারের চারটি ক্ষেত্রের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো: রাশিয়া বা মিত্রদের ভূখণ্ডে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, রাশিয়া বা মিত্রদের বিরুদ্ধে পারমাণবিক বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার, রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বা সামরিক স্থাপনায় হামলা, যার ফলে পারমাণবিক সক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করে আগ্রাসনের ফলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে।

বিশ্বে পারমাণবিক বোমার মজুদ

বিশ্বের নয়টি দেশের কাছে বর্তমানে ১৩ হাজার ৪০০টি পারমাণবিক বোমা আছে বলে জানিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি)।

রাশিয়া: স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) তথ্য অনুসারে রাশিয়ার কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। দেশটিতে এ ধরনের বোমার সংখ্যা ৬ হাজার ৩৭৫টি। ১৯৪৯ সালে রাশিয়া প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে এবং একমাত্র দেশ যারা যুদ্ধেও এই অস্ত্র ব্যবহার করেছে। দেশটির কাছে এখন ৫ হাজার ৮০০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে।

চীন: ৩২০টি পারমাণবিক বোমা আছে চীনের। রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সংখ্যাটা কম হলেও দেশটি ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়াচ্ছে। যেমন- ২০১৯ সালেই তাদের কাছে ২৯০টি বোমা ছিল। স্থল, আকাশ বা সমুদ্রপথে সেগুলো ছোঁড়া সম্ভব।

তাছাড়া ফ্রান্সের কাছে পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে ২৯০টি। ২১৫টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে যুক্তরাজ্যের কাছে। পাকিস্তানের আছে ১৬০টি আণবিক বোমা। আর ভারতের কাছে এখন ১৫০টি বোমা রয়েছে। ইসরায়েল অবশ্য নিজের দেশের পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে স্বীকার করে না। দেশটির ৯০টি পারমাণবিক ‘ওয়ারহেড’ আছে বলে উল্লেখ করেছে সিপ্রি। উত্তর কোরিয়ার কাছে থাকা বোমার সংখ্যা আনুমানিক ৩০ থেকে ৪০টি।

আগ্রাসী নীতিতে ফিরছে বিশ্ব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয় তাতে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষেরা আতংকিত হয়ে ওঠে। পারমাণবিক অস্ত্রের সর্বনাশা ধ্বংস থেকে বাঁচানোর জন্য শান্তিকামী মানুষেরা আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে স্বাক্ষরিত হয় পারমাণবিক প্রতিযোগিতা বিস্তার রোধ চুক্তি এনটিপি ও সিটিবিটি।

১৯৬৮ সালের মার্চে সর্বপ্রথম স্বাক্ষরিত হয় পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত চুক্তি এনটিপি। প্রাথমিকভাবে ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তিতে ৪০ টি দেশ স্বাক্ষর করে। চুক্তিটি ১৯৭০ সালের ৫ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। ২৫ বছর শেষে ১৯৯৫ সালে নিউইয়র্ক শহরে এ সংক্রান্ত এক সম্মেলনে চুক্তিটির মেয়াদ অনিদির্ষ্টকালের জন্য নবায়ন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ বিশ্বের মোট ১৭৪টি দেশ এতে স্বাক্ষর করলেও ভারত,পাকিস্তান, ইসরাইল এবং কিউবা এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।

বর্তমান বিশ্বে পরমাণু অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি নিয়ে ফের উত্তেজনা চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবার প্রথমবারের মতো জার্মানি বিদেশি কোন দেশকে অস্ত্র সরবরাহ করলো। এমনকি দীর্ঘ দিনের সামরিক নীতি পরিবর্তন করে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নাম লিখালো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পর প্রথমবারের মতো তারাও ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠালো। যদিও এটি কোনো সামরিক জোট ছিল না। ইউরোপের অনেক দেশই অস্ত্রের মজুদ বাড়াচ্ছে। ফলে অস্ত্রের ব্যবসা চাঙা হলেও ব্যর্থ হচ্ছে নিরস্ত্রীকরণ প্রচেষ্টা আর মানবতাবোধ। তাই আরো একটু আগ্রাসী আর অস্ত্রবাজ পদক্ষেপের দিকে বিশ্ব আগাচ্ছে বলে শঙ্কা বাড়ছে শান্তিকামী মানুষের।

সংবাদটি শেয়ার করুন