বেসরকারি খাত————
দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত
গেল ২৯ মাসে সর্বোচ্চ, প্রায় ১৩ লাখ কোটি টাকা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়া দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। নতুন বছর বিনিয়োগের একটি ইতিবাচক আবহ নিয়েই শুরু হচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতিতে পুরোপুরি গতি ফিরবে। তবে এর বেশি হলে কিছুটা সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে।
করোনা সংক্রমণ কমে আসার পর দেশে আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে। যে কারণে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা বেড়েছে ব্যাপক হারে। টানা সাত মাস বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল চলতি বছরের জানুয়ারিতেও। গত ২৯ মাসের মধ্যে জানুয়ারির ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল সর্বোচ্চ। তবে এতো বেশি প্রবৃদ্ধিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের টার্গেট পূরণ হয়নি। এ প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টার্গেটের থেকে অনেকটা কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১১ দশমিক ০৭ শতাংশ। গত ২৯ মাসের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিক পরিমাণ আমদানি বৃদ্ধি, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ার ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতো বেশি প্রবৃদ্ধিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের টার্গেট পূরণ হয়নি। এ প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টার্গেটের থেকে অনেকটা কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত আমদানি সংক্রান্ত হালনাগাদের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) সময়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা পণ্য আমদানি করেছেন চার হাজার ২১২ কোটি ২৫ লাখ ডলারের। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৪ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের এই ছয় মাসে ২ হাজার ৭২৬ কোটি ৯২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল, যা ছিল আগের বছরের (২০১৯-২০) জুলাই-ডিসেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। গত বছরের (২০২১ সাল) জানুয়ারিতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪০ হাজার ২৩ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে বেসরকারি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৬৬ হাজার ২২৩ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়া দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। নতুন বছর বিনিয়োগের একটি ইতিবাচক আবহ নিয়েই শুরু হচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতিতে পুরোপুরি গতি ফিরবে। তবে এর বেশি হলে কিছুটা সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলতি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এর ফলে অর্থনীতিতে পুরোপুরি গতি ফিরবে। তবে এর বেশি হলে কিছুটা সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল। সেখানে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বর শেষে উদ্যোক্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যের চেয়ে এখনও প্রায় ৪ শতাংশ ঋণ কম নিয়েছেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন পরে জানুয়ারিতে এত বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের টার্গেট থেকে তা অনেকটা কম। আমি মনে করি চলতি বছর খুবই কঠিন যাবে। আমরা যতটা পারি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের ওপর বাহ্যিক প্রভাব পড়ছে। তেলের দাম বাড়ছে, গমের দাম বাড়ছে, ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে বহু দেশই শঙ্কিত। তবে প্রভাব এখনই বোঝা যাবে কি না নিশ্চিত নয়। চার-ছয়মাস পরেও তা দৃশ্যমান হতে পারে।
সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ইউরোপ বলছে রশিয়ার গ্যাস নেবে না। এর কারণে গ্যাসের সংকট হবে কি না, তা নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই অনিশ্চয়তার কারণে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে ধস নামছে। আমরা ছোট দেশ হলেও গ্লোবাল ভিলেজের অংশ। কোথাও কিছু হলে সারা বিশ্বে তার প্রভাব পড়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোভিডের কারণে গত মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি খুবই কম ছিল। সে সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ছে। ২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১ ও ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলে তা নেমে আসে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। মে মাসে তা আরও কমে নেমে যায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে।
তবে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশে উঠে কিছুটা পুনরুদ্ধার ঘটে। তারপর থেকে ঋণপ্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্টে এই সূচক ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৮ ও ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ।