মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জামালপুরে

শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লিবিনোদনে অভূতপূর্ব সংযোজন

জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহিদুর রহমান দুই সন্তানকে নিয়ে প্রায়ই ঘুরতে বের হন। কিন্তু উপজেলায় তেমন কোনো বিনোদনকেন্দ্র না থাকায় সন্তানদের বিনোদনের চাহিদা পূরণ করতে পারেন না তিনি। বাধ্য হয়েই নদীর পাড় কিংবা শপিংমলে গিয়ে বিভিন্নভাবে ওদের নিবৃত্ত করেন। জামালপুরে সাংস্কৃতিক পল্লি হওয়ার খবর পেয়ে তিনি উল্লসিত।

শাহিদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার তো ঢাকার ফ্যান্টাসি কিংডম কিংবা নন্দন পার্কে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। জামালপুরে সাংস্কৃতিক পল্লি চালু হলে দুই সন্তানকে অন্তত আনন্দ দিতে পারব।’ শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লিতে আধুনিক সিনেপ্লেক্স থাকায় আনন্দিত এলাকার অনেকে।

জেলার দেওয়ানগঞ্জের সাধারণ ব্যবসায়ী সিনেপ্রেমী রুপম পোদ্দার নিয়মিত সিনেমা দেখেন। তিনি বলেন, ‘ভালো পরিবেশে আধুনিক সিনেমা দেখতে হলে ঢাকায় যেতে হয় আমাদের। তাতে অর্থের পাশাপাশি অনেক সময়ও ব্যয় হয়। সাংস্কৃতিক পল্লি চালু হলে হাতের কাছেই বিশ্বমানের সিনেমা হল পাব আমরা। ভাবতেই আনন্দ লাগছে আমার।’

জায়গা কিংবা স্থায়ী আবাসনের অভাবে জামালপুরের অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এ পল্লিতে জেলার সক্রিয় সংগঠনগুলোকে স্থায়ী কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে জামালপুরের সাংস্কৃতিক কর্মী ফাহিম মালেক বলেন, ‘এই সাংস্কৃতিক পল্লিতে যদি সংগঠনগুলো স্থায়ী জায়গা পায়, তাহলে জামালপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন কিংবা কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে বলে আমি মনে করি।’

জামালপুর জেলার মানুষের হাতের নাগালে বিশ্বমানের পরিকল্পনায় অবকাঠামো ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা নিয়ে সরকারি অর্থায়নে তৈরি হয়েছে দেশের প্রথম আইকনিক বিনোদন পার্ক। এটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লি’।

জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র দয়াময়ী মোড়সংলগ্ন এলাকায় প্রায় ৮ একর জায়গার ওপর নির্মিত হয়েছে পার্কটি।
এ পার্কের জমি অধিগ্রহণে জামালপুর পৌরসভা থেকে প্রায় ৫৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আর পার্কের অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাত বাবদ এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
কাজটি পরিচালনা করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের জামালপুর জেলা অফিস।
২০১৭ সালের শুরুতে পার্কটির কাজ শুরু করা হয়। পার্কটির সব কাজ প্রায় শেষ হলেও আপাতত এটি চালু হচ্ছে না। কয়েক দফা চালুর তারিখ নির্ধারণ করা হলেও সেগুলো ঠিক থাকেনি।
তবে পার্ক তদারককারী কর্তৃপক্ষ এলজিইডি জামালপুর অফিস থেকে জানা যায়, ২০২৫ সালের জুনে এ বিনোদন পার্কটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।

আরও পড়ুনঃ  বিলুপ্তির পথে তালার শাহী মসজিদ

দেশের প্রথম এই আইকনিক বিনোদন পার্কে কী থাকছে সবার জন্য, তা নিয়ে কৌতূহল অনেকের।
এলজিইডি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ পার্কে মূল বিল্ডিং রয়েছে ৫টি। এখানে বৃহৎ আকারের মিউজিয়াম রয়েছে। যেটির সম্পূর্ণ কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন। এ মিউজিয়ামে জামালপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলি স্থান পাবে। একমাত্র সাংস্কৃতিক ভবনের কাজও শেষ।

সুদৃশ্য বোট ক্লাবের কাজ কিছুদিন আগে শেষ হয়েছে। দেশের বিনোদন পার্কগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম এখানে নাইন ডি থিয়েটার স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে এইচডি সিনেপ্লেক্স। আউটডোর স্থাপনাগুলোয়ও রয়েছে নানা চমক। এর মধ্যে একটি হলো ‘ওয়াটার ফাউন্টেন’। এটি লেকের মতো একটি রাইড। দুবাইয়ের আদলে এটি স্থাপন করা হয়েছে। এখানে মিউজিকের তালে তালে বিভিন্ন কালারের পানি উঠানামা করবে। রয়েছে আউটডোর লাইটিং।
বিনোদনপিয়াসীদের জন্য রয়েছে ‘ফেরিজ হুইল’ নামের বৃহৎ আকারের ‘চরকি’। যেখানে ৩৬০টি সিটে মানুষ একসঙ্গে বসতে পারবেন। এটিও দেশের প্রথম স্থাপনা। সিঙ্গাপুরের আদলে এটি তৈরি করা হয়েছে।
পুরো সাংস্কৃতিক পল্লিকে সাজানো হচ্ছে নানা দৃষ্টিনন্দন আর্কিটেকচারাল ডিজাইনে। শহিদ মিনার ও মিউজিয়ামের পর থাকবে খোলা মাঠ, থাকবে সুদৃশ্য বৃত্তাকার লেক। লেকের চারপাশে ওয়াকওয়ে। লেকের পশ্চিমে থাকবে মুক্ত থিয়েটার মঞ্চ। মঞ্চটি এমনভাবে তৈরি হবে, দেখে মনে হবে এটি পানিতে ভাসছে। লেকের পশ্চিমে থাকবে শিশুদের জন্য চিলড্রেন আর্ট প্লাজা। লেকের মাঝখানে আছে সুদৃশ্য হাঁটার সেতু।

এছাড়াও পল্লির মূল কালচারাল ভবনে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এখানে নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চা ও রিহার্সেলের সুযোগ পাবে। এছাড়া রয়েছে ৬ তলাবিশিষ্ট একটি মার্কেট। যেখানে ৫৮টি দোকান রয়েছে। এ দোকানগুলোর প্রাপ্ত আয় থেকে পার্কের পরিচালনা ব্যয় মেটানো হবে বলে জানিয়েছে পার্ক কর্তৃপক্ষ।
২০২১ সাল থেকে পার্কটির কাজ পরিচালনা করেছেন জামালপুর জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সায়েদুজ্জামান সাদেক।

আরও পড়ুনঃ  ঝিনাইদহে মাছ কুটে জীবন চালানো ৬ নারীর গল্প

পার্কটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিনোদনপিয়াসীদের জন্যই জামালপুরে এ পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। এ প্রজেক্ট পরিদর্শন করলে জামালপুরের ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধে এ এলাকার ইতিহাস দর্শনার্থীরা জানতে পারবেন। এ পার্ক সারা দেশে নতুনমাত্রা যোগ করবে বলে আমি মনে করি।’শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ময়মনসিংহ বিভাগের সবচেয়ে আলোচিত জেলা জামালপুর। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও এ জেলার রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। এখান থেকে বিকশিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতি ছড়িয়েছেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি হাসান হাফিজুর রহমান, নাট্যকার ও নির্মাতা আমজাদ হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, ওস্তাদ ফজলুল হক, গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু, চলচ্চিত্র পরিচালক এসএ হক অলিক প্রমুখ।

জামালপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন সব সময়ই সক্রিয়। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এখানে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে অনেকদিন ধরেই।

এ সাংস্কৃতিক পলিকে ঘিরে জামালপুরে স্থানীয় সাংস্কৃতিককর্মী ও সুধীজনদের আগ্রহও অনেক। এ নতুন আইকনিক স্থাপনা নিয়ে তাঁদের রয়েছে নিজস্ব আশা-প্রত্যাশা। জামালপুরে শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লি তাই বিনোদনে অভূতপূর্ব এক সংযোজন।

জামালপুর জেলা উদীচীর সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আলী ইমাম দুলাল বলেন, ‘জামালপুরের সক্রিয় সব সাংস্কৃতিক সংগঠন যেন এ পল্লিতে জায়গা পায় এবং মিলেমিশে থাকেÑআমি এ প্রত্যাশাই করি।’

জামালপুরে পুরোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন মনিমেলার সভাপতি সিদ্ধার্থ শংকর বলেন, ‘এ পল্লি খুবই সময়োপযোগী একটি কাজ। এটি যেখানে স্থাপন হলো, সেখানটায় আমাদের সংগঠনের স্থায়ী জায়গা ছিল ১৯৯২ সাল থেকে। আমরা ৫২ বছর ধরে জামালপুরে এই সংগঠন চালাই। আমাদের প্রত্যাশা, বৃহৎ ও সক্রিয় সংগঠনগুলোই যেন এ পল্লিতে স্থায়ী জায়গা পায়। শুনেছি আমাদের সংগঠনের জন্য ৬ তলায় জায়গা দেওয়া হবে। আমাদের সংগঠনের সদস্যদের বেশির ভাগই শিশু। তাদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে নিচতলায় জায়গা দিলে উপকৃত হবে সবাই।’
জামালপুরের নবাঙ্কুর সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি রফিকুজ্জামান মল্লিক তুষার বলেন, ‘জামালপুরে আমরা অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। বিশেষ করে ঘর ভাড়া বাবদই আমাদের অনেক অর্থ ব্যয় হয়। যদি এ পল্লিতে বিনামূল্যে স্থায়ী জায়গা পাই, তাহলে সাংস্কৃতিক শিক্ষাটা সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারব।’

আরও পড়ুনঃ  পারাপারে ৫শ’ পরিবারের ভরসা সাঁকো

জামালপুরে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘জামালপুরে বিনোদনপিয়াসী মানুষের খুব চাহিদা ছিল এই ধরনের একটা পার্কের। পার্কটির মাধ্যমে সেই আশা পূরণও হলো। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম শহর থেকে খানিক দূরে, যেখানে যানজট থাকবে না এবং সর্বসাধারণ সহজেই যেতে পারবে। কিন্তু এর পরিবর্তে এটা হয়ে গেল শহরের মাঝখানে। যেখানে পার্কটি হলো, সেখানে ঐতিহ্যবাহী মেলা হতো, অষ্টমী মেলা বসত, জনসভা হতো। তাছাড়া গরমের সময় শীতল হাওয়ার সন্ধানে এই মাঠে এসে বসতেন সবাই। আগের সেই মাঠটি হারিয়ে আমরা ব্যথিত। তারপরও সঠিক ব্যবস্থাপনায় পার্কটি যদি পরিচালনা করা হয়, তাহলে আমাদের মনের কষ্ট কিছুটা কমবে।’

জামালপুর জেলা কালচারাল অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুন সাংস্কৃতিক পল্লি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জামালপুরের জন্য এ সাংস্কৃতিক পল্লি একটি মাইলফলক। এটি আঞ্চলিক সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম একটি জায়গা হবে। জাতীয় পর্যায়ের সংস্কৃতির সঙ্গে আঞ্চলিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরি করবে এ পল্লিটি।’

লেখক : সাংবাদিক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন