ঢাকা | বৃহস্পতিবার
২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শীতের আগমনী বার্তা, নবরূপে জাবি ক্যাম্পাস

শীতের আগমনী বার্তা, নবরূপে জাবি ক্যাম্পাস

প্রকৃতিতে শীত এসে গেছে,আর নবরূপে সেজেছে জাবি ক্যাম্পাসের প্রাণ-প্রকৃতিও। তবে কবিতার কল্পনালোকের মতো এতো গতিচাঞ্চল্যে শীত আসেনি। সময়ের পরিক্রমায় শীত এসেছে  চার ঋতু অর্থাৎ আট মাসের বিরতির পর। ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে ক্যাম্পাস-প্রকৃতিও সাজে ভিন্ন রূপে। হেমন্তের বিদায়বেলায় শীত কড়া নাড়ছে প্রকৃতিতে। সকালের মিষ্টি রোদে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে হিমেল হাওয়া তার আগমনী বার্তা নিয়ে আসছে। এখানে খুব ভোরে দূর্বাঘাসে শিশিরবিন্দু জমে থাকে মুক্তোর মতো। কুয়াশার মায়াবী চাদর যেন চারপাশকে জড়িয়ে রাখে। লেকের নির্মল-স্বচ্ছ পানিতে সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়ে। মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস ভোরের পথচারীদের আচ্ছন্ন করে রাখে।

এবার শীতও এসেছে অন্যবারের চেয়ে খানিকটা আগেই। তবে এই ক্যাম্পাসে ছোট বেলায় ‘শীতের সকাল’ রচনার মতো দিগন্ত জোড়া মাঠের প্রান্তে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীত আসে না, এখানে শীত উপলব্ধি করা যায় ইট-কাঠ ঘেরা শহরে অলিগলিতে শীত নামে কর্মব্যস্ত মানুষের পদচারণায়,কুয়াশা মোহনীয়তায় আর প্রাণ প্রকৃতির নবসাজে উদ্দেলীত তারুণ্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি এখানকার অধিবাসী শিক্ষার্থীদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক গ্রামে পরিণত করেছে। ফলে এখানে শীতের আগমণ ঘটে দারুণ বৈচিত্র্য নিয়ে। ইট-পাথরে ঘেরা শহরের মধ্যেও গ্রামের শীতের আমেজ সৃষ্টি হয় জাহাঙ্গীরনগরের প্রাণ-প্রকৃতিতে।

জাবি ক্যাম্পাসে শীত মানেই জাঁকালো আয়োজন:

মুক্তমঞ্ছ ও সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণে শুরু হয় উৎসব। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীত আসার শুরুতেই আগমণীবার্তা নিয়ে আসতে শুরু করেছে শীতের পাখিরা। সুদূর সাইবেরিয়ার থেকে প্রতিবছর ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসে জাবির লেক সমূহে। আর লেকগুলোও যেন পাখিদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিলো আগে থেকেই। লাল শাপলা হাসিমুখে স্বাগত জানিয়েছে এই অতিথি পাখিদের। সকালে ফুটন্ত শাপলাগুলোতে পাখিদের ল‍ুকোচুরি সে এক অভিভূত করার মতো দৃশ্য। শুধু তাই নয় শীতে এখানকার ছাত্র-শিক্ষকের সকালের ঘুম ভাঙে অতিথি পাখির কলকাকলীতে। অতিথি পাখিদের মেলাবসে বিশ্বিবদ্যালয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার’র পেছনের লেক, জাহানারা ইমাম এবং রেজিস্ট্রার ভবন সংলগ্ন লেক ইত্যাদিতে। অন্তত কয়েক হাজার অতিথি পাখির কলকাকলীতে মেতে ওঠে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ। উপযুক্ত পরিবেশ আর নিরাপদ আশ্রয়ে এসব অতিথি পাখি নির্ভাবনায় কলকাকলী ও জলকেলিতে বিভোর থাকে জাবির লেকসমূহে ।কেউ আবার ডুব সাঁতারে ব্যস্ত। কখনও কখনও চক্রাকারে উড়ে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পাসের মুক্ত আকাশে। তাদের এ কার্যকলাপ দেখতে এবং ক্যামেরাবন্দি করতে ক্যাম্পাসের শিক্ষা ছাড়াও প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য পাখিপ্রেমী পর্যটকের সমাগম ঘটছে। আসছেন দেশ বিদেশি দর্শনার্থীরা ও পাখি গবেষকগণ।

শীতের আগমনীতে ক্যাম্পাসে প্রতিবছর পাখিমেলার আয়েজন করা হয়। এছাড়াও প্রজাপতি মেলায় মুখর হয়ে ওঠে জাবি প্রাঙ্গন। শীতের কুয়াশায় জাবির লেকগুলোতে যেনো বাহারি ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে। জেনারেটরের লেকে বাহারি কচুরীপানার সাথে ফুটেছে লাল ও সাদা শাপলা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি সংলগ্ন ছোট্ট ছোট পুকুরটিতে ফুটেছে সাত প্রকারের শাপলা যার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মোহনীয় ও সুগন্ধযুক্ত বেগুনি শাপলা। এছাড়াও জাবির লেকগুলোতে ফুটে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির কচুরিপানা ফুল। বিশ্ববিদ্যারয়ের ছোট বড় প্রায় ১০টারও বেশি লেক রয়েছে। যার প্রতিটি লেকে শাপলা আর কচুরিপানা ফুলের চিরায়ত রাজত্ব যা শীতে জাবির প্রাকৃতিকে সৌন্দর্যে মোহনীয় করে তুলে আর এর মাঝে মাঝে পাখিদের লুকোচুরি প্রকৃতির নিকটে নিয়ে যায় জনজীবন ।   

জাবি ক্যাম্পাসে যে শীত এসছে পড়েছে তা বোঝা যাচ্ছে গোধূলীর সোনালী সূর্য অস্ত না যেতেই মাঝারি কুয়াশার চাদরে আকড়ে ধরা প্রকৃতিতে, ভোরে সূর্য রশ্মির গাছে পাতার হালকা শিশিরে প্রতিফলিত হওয়ার দৃশ্যে। হালকা হিমেল বাতাসে মৃদু কাঁপন ধরানো অনুভূতি ক্যাম্পাসবাসীর গায়ে শীতের ফ্যাশনের বার্তা জানিয়ে দেয়। ফলে ফ্যাশন সচেতন তরুণেরাই এগিয়ে নানা ডিজাইনের হুডি ও শীতের কাপড়ের যোগাড়ে।এখানে শীতকে শুধু প্রতিরক্ষাই নয় বরং শীতের কাপড়কে কি করে আরো ফ্যাশনেবল করে তোলা যায় সে বিষয়ে নিরন্তর চেষ্টার কোন অন্ত রাখে না জাবি শিক্ষার্থীরা।

জাবিতে শীতে আগমনে ক্যাম্পাসের পিঠার দোকানগুলোতে শুরু হয় নতুন আয়োজন। শীতের পিঠা-পুলিতে রসের মেলা বসে এখানে। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত এসব দোকানে চলে শীতের নানা রকম পিঠা পুলি তৈরি উৎসব।এসব দোকানে ভিড় লেগেই থাকে শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, পরিবহন চত্বর, বঙ্গবন্ধু হল চত্বর, মীর মশাররফ হোসেন হল, জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা নিকটে এ চত্বরসমূহে পিঠার জন্য বিশেষ ভাবে গড়ে ওঠে অস্থায়ী স্টল।এছাড়াও মেডিকেল সংগলগ্ন পিঠা চত্বরে শীতের পিঠা তৈরি ও খাওয়ার ভিড় লেগে যায়। শুধু ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা নয়, শীতের পিঠা পুলির দূর থেকে ছুটে আসেন সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকার আশপাশের ভ্রমণপিপাসু মানুষজন।

শীতের আগমনের সাথে নতুনরূপে সাজে জাবির বটতলা,বেড়ে যায় খাবারের নতুন আইটেম।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বটতলার টেস্ট না করে না চলে যান এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বটতলার বাহারী খাবারের মধ্যে অন্যতম ঢেড়স, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলা, বরবটি, টমেটো ,লাউ, শিম পালং ইত্যাদি শীতের শাক-সবজি। বিভিন্ন মাছ,মাংস।এখানে বিশেষ আকর্ষণে থাকে জাবির ভর্তা।শীতে বাহারি পদের ভর্তায় বরাবরই মুগ্ধ সবাই।এছাড়া শীতের বিভিন্ন ফল যেমন জলপাই, চালতা , সফেদা , তেঁতুল ফল এবং তাদের আচারও পাওয়া যায় জাবি ক্যাম্পাসে।  

জাবিতে শীতের প্রতীক ও অন্যতম আকর্ষণ খেজুর রস। এখানে খেজুরের রস ছাড়া শীতকে যেন কল্পনাই করা যায় না। জাবিতে কাকডাকা ভোরেই পাওয়া যায় সুমিষ্ট খেজুর রস। ক্যাম্পাসে খেঁজুর গাছ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের গ্রামগুলো থেকে সংগৃহীত টাটকা খেঁজুরের রসই শিক্ষার্থীদের শীতের আমেজ ধরে রাখে। এসব খেজুর রস পাওয়া যায় পরিবহন চত্বরে, যা শীতের আমেজকে আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলেছে।

সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীত মানেই সাংস্কৃতিক উৎসবের ধুম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন যেমন জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, জলসিঁড়ি, আনন্দন, ধ্বনি, গীতনাট, জুডো, জাডস প্রভৃতি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতেই শীতের আগমনী বার্তা পৌঁছে যায় ক্যাম্পাসের পথে প্রান্তরে । নাটক, গান সাংস্কৃতিক আয়োজন, তর্ক-বিতর্ক ও গল্প ছন্দে মেতে ওঠে জাবির প্রাণ প্রকৃতি।যেন শীতের আগমনী বার্তা জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস কে স্বপ্নপূরী নগরী তে পরিণত করে।

সংবাদটি শেয়ার করুন