ঢাকা | বৃহস্পতিবার
২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে লাল-সাদা শাপলা

হারিয়ে যাচ্ছে লাল-সাদা শাপলা

শাপলা হলো আমাদের জাতীয় ফুল। এক সময় পুকুর খাল বিল ও জলাশয়গুলোতে তাকালেই বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে চোখে পড়ত লাল ও সাদা শাপলা। শাপলার সৌন্দর্য দেখতে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসত। বর্ষা থেকে শীত পর্যন্ত ওইসব জায়গাতে প্রাকৃতিকভাবে শাপলা জন্মাতো। তাছাড়া শাপলা ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় সবজি হিসেবে এর কদর থাকায় তা বিক্রি করে অনেকেই টাকা উপার্যন করতো। কিন্তু বর্তমানে সেই শাপলা আর তেমন চোখে পড়ছে না। তবে কিছু কিছু জায়গাতে সাদা শাপলা দেখা দেলেও তাও রয়েছে অনেক সীমিত। জলবাযুর পরিবর্তন, পানির অভাবসহ নানা কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা থেকে প্রায় অনেকটাই যেন লাল সাদা শাপলা হারিয়ে যেতে বসেছে।

সাধারণত শাপলা ফুল গোলাপী, সাদা, নীল, বেগুনি ইত্যাদি রঙের হয়ে থাকে। শাপলা ফুল অনেক রঙের হলেও কেবল সাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের পয়সা, টাকা, দলিলপত্রে জাতীয় ফুল শাপলা বা এর জলছাপ আঁকা রয়েছে। এক সময় এ উপজেলার বিভিন্ন খাল বিল, জলাশয়, পুকুর, নালাতে বছরের প্রায় সব সময় কমবেশী শাপলা ফুটতে দেখা যেতো।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। সাধারণ শাক-শবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুন অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুন বেশি। ডায়াবেটিস, বুক জ¦ালা, লিভার, ইউরিনারী সমস্যার সমাধানসহ নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার তারাগন বিল, দেবগ্রাম বিল, খালাজোড়া বিল, বিল আড়িয়াজলা, কুড়িবদ্ধসহ বিভিন্ন বিল সব জলায়গুলো বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে শাপলা ফুল ফুটতো। বর্ষা ভরা মৌসুমে ওইসব জায়গা রঙবেরঙের শাপলায় দর্শনীয় স্থানে পরিণত হতো। বিভিন্ন জায়গার লোকজনরা তা দেখতে ভিড় করতো।

এর মধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল শাপলার প্রতি আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এ ফুল ফোটা শুরু হয়ে প্রায় চার মাস পর্যন্ত শোভা বৃদ্ধি করতো। প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নিতো ওইসব শাপলা। বর্তমান সভ্যতায় বাড়তি জনগণের চাপের কারণে আবাদি জমি ভরাট করে বাড়ি, পুকুর, মাছের ঘের বানানোর ফলে বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ যেমন কমছে, তেমনি শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে। তাছাড়া জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদের কারণে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, খাল-বিল ও জলাশয় ভরাটের কারণে এ উপজেলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে লাল শাপলা।

উপজেলা পরিবেশ আন্দোলনের সদস্য সাংবাদিক মো: রুবেল আহমেদ বলেন, শাপলা হলো বাংলার একটি এতিহ্য। ছোট বড় ছোট সকলের কাছে শাপলা খুবই প্রিয়। আসলে শাপলা পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি হওয়ায় গ্রামাঞ্চলে অনেক লোকজন এটিকে খাদ্য তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছিল। এক সময় খাল বিলে প্রচুর শাপলা পাওয়া যেতো।

শাপলার ঢ্যাপ দিয়ে খৈ জাতীয় খাবার তৈরি করা হতো। মৌসুমী শাপলা বিক্রি করে অনেকে অর্থ উপার্জন করতো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমি ভরাট করে বাড়িঘর তৈরী, বিলের জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষাবাদের কারণে কীটনাশক প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, খাল-বিল ও জলাশয় ভরাটের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা। গ্রামাঞ্চলের সৌখিন লোকজনার পুকুরেও শাপলা চাষ করতেন। তবে পুকুরে মাছ চাষের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় সেখান থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা।

মো: বাবুল মিয়া বলেন গত কয়েক বছর আগেও বর্ষার শুরু থেকে শরতের শেষভাগ পর্যন্ত খাল বিল জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণ লাল সাদাসহ নানা জাতের শাপলা দেখা যেত। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসতো। তাছাড়া ওইসব জায়গা থেকে শাপলা তুলে অনেকে স্থানীয় হাট বাজারে বিক্রি করে ভালো টাকা আয় করতো। এখন আর আগের মতো শাপলা চোখে পড়ে না। হাট বাজারে কিছু পাওয়া গেলে ও রয়েছে অনেক দাম।

মো: মোবারক হোসেন বলেন, এক সময় খাল বিলের মধ্যে আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন- এই চার মাস প্রচুর শাপলা ফুল দেখা যেতো। আগের মতো এখন আর তেমন শাপলা ফুল দেখা যায় না। তবে স্বল্প পরিমাণে কিছু সাদা শাপলা দেখা মিললেও লাল শাপলা নেই বলে চলে।

উপজেলা উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, সাধারণত শাপলা সাদা, বেগুনি ও লাল রঙের হয়ে থাকে। এর মধ্যে সাদা ফুলের শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ওষুধি কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়। পুষ্টিমানে শাপলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি সবজি। সাধারণ শাক-সবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুণ বেশি। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি। খাল-বিল ও আবদ্ধ জলাশয়গুলো দিন দিন শুকিয়ে যাওয়ার কারণে শাপলার শালুক নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে শাপলার বংশ বিস্তার বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। তাছাড়া চাষের জমিতে অধিক মাত্রায় আগাছা নাশক ও কীটনাশক প্রয়োগ করা ও নিচু জলাশায় জমি ভরাট করে বসতি স্থাপন করার কারণে শাপলার বংশ বিস্তার দিন দিন কমে যাচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন