- সরকারের সদিচ্ছায় ফিরবে নদীর প্রাণ
ভরা বর্ষায় টইটম্বুর নদী। দুপাড়ে ছাপিয়ে জল ঢুকছে লোকালয়ে। আসছে বড়ো বড়ো শস্য কিংবা পশু বোঝাই বজরা। মাছ ধরতে ব্যস্ত জেলেদের ডিঙিগুলো। দিনাজপুরের আমবাড়ী হাটের গল্প এককালে ছিল এমন। তবে, এ জনপদের জন্মদাত্রী ইছামতি নদীর শেষকৃত্য এখন সম্পন্নপ্রায়। নদীর যে অস্তিত্ব আছে, তাও বোঝা দুষ্কর হবে সিংহভাগ স্থানে। মাঝেমধ্যে দু-একটা সাঁকোয় করুণাবশত নাম লেখা থাকে বলে জানা যায়, ‘এইখানে এক নদী ছিল’।
বাংলাদেশ ইছামতি নামে নদী আছে পাঁচ থেকে ছয়টি। এদের অবস্থান যথাক্রমে দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, পাবনা, কুষ্টিয়া ও রাঙমাটিতে। প্রথম চারটি এককালে সংযুক্ত ছিল বলে জানা যায়। শেষোক্ত পাঁচটি ইছামতির অবস্থা ভালো না হলেও একেবারে নিশ্চিহ্ন নয়। দিনাজপুরের ইছামতি নদীই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এ নদী এখন বিলীনপ্রায়।
অথচ এ ইছামতিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল আমবাড়ী, রাণীরবন্দরসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। দিনাজপুরের অন্যসব নদীর মতোই চূড়ান্ত অবহেলার কবলে পড়ে শেষ হতে চলেছে এ নদীটি। নদী খননে নূন্যতম পদক্ষেপটুকুও নেয়া হয়নি কখনো। ফলে দখলে-দূষণে নদী হারিয়েছে তার গর্ভ। বর্তমানে ইছামতি পুরোদস্তুর চাষের আবাদি জমি, মাঝে মধ্যে একটা দুটো খানা-খন্দ বলছে এখানে কখনো নদী ছিলো। এখন তাও বন্ধ করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে।
ইছামতি নদীটির উৎপত্তি এ জেলারই খানসামা উপজেলার আঙ্গরপাড়ার বিলাঞ্চলে। প্রায় ৭০ মাইল দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ি উপজেলার পাশ ঘেঁষে সীমান্ত পৃথক করে ভারতে গিয়ে আত্রাই নদীতে পতিত হয়েছে এটি। ইছামতি থেকে জন্ম নেয়া আরও দুটো নদী হলো-ছোট যমুনা ও ভেলামতি। পুরোনো পাড়ের চিহ্ন বলছে, নদীর গড় প্রস্থ ১৫০ মিটার ছিল। এখন অবশ্য ১৫ মিটারও পাওয়া যাবে না অনেক জায়গায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঝোলানো ব্যানারে কোথাও নদীকে ডাকা হয়েছে মরা ইছামতি খাল, কোথাও এর দৈর্ঘ্য দেখানো হয়েছে মাত্র ২৭ মাইল।
কুতুবডাঙ্গা সেতুর কাছে দেখা গেছে, গতিপথ কেটে নদীর শাসন করার পুরোনো প্রচেষ্টা। চিহ্ন মুছতে থাকলেও দীর্ঘদেহী সেতু বানাতে কার্পণ্য করা হয়নি এতটুকু। যেন নদীর জীবিত থাকাটা জরুরি নয়, সেতু বানিয়ে তাতে উদ্বোধনের নামফলকটা বসানোই সার্থকতা।
ইছামতি অববাহিকায় ধানচাষ হয় প্রচুর। এ অঞ্চলের শতকরা নব্বইভাগ মানুষ কৃষক। জলাঙ্গী সচল থাকলে যে তাদের কতোখানি উপকার হতো, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু যে নদীর চিহ্নই নেই, সে জল ধরবে কোত্থেকে!
এ হাল কেন হলো ইছামতির? উত্তর দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। জবাব খুঁজতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের। উত্তরে মেরুকরণের এ দুর্দিনে একটি নদীও যদি হারিয়ে যায় মানচিত্র থেকে, তবে সে ক্ষতি হবে অপূরণীয়, এবং তার মাশুল দিতে হবে আমাদেরই। অবিলম্বে তাই খননের তালিকায় ওঠানো হোক ইছামতির নাম। পূণর্ভবা, গর্ভেশ্বরী, তুলাই, ঢেপার সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রাণ আসুক ইছামতিরও। এ আশা এখনো লালন করেন নদীপাড়ের হাজারো মানুষ। তাই যে করেই হোক, ইছামতিকে বাঁচাতেই হবে। সম্প্রতি নদ আন্দোলনের সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল বাংলাদেশে’র তরফে ‘ইছামতী নদী রক্ষা কমিটি’ প্রণয়ন করা হয়েছে আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপের জন্য। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ইছামতির প্রাণ ফেরানো অসম্ভব কিছু নয়-এমনটাই মনে করছেন স্থানীয়রা।