মহাবিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক শক্তি ও সম্পদের উৎস হচ্ছে সমুদ্র। একদিকে যেমন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে সমুদ্রের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতাও বাড়ছে। কিন্তু বিভিন্ন প্রকার দূষণের কবলে পড়ে দিন দিন সমুদ্র তার স্বরূপ হারাচ্ছে এবং দূষণের করাল গ্রাসে পরিণত হচ্ছে। প্লাস্টিকসহ নানা দূষণের কারণে আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে সাগর ব্যবহার অযোগ্য হয়ে ওঠতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকরা। এ অবস্থার পরিবর্তনে সমুদ্র সংক্রান্ত জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বড়ি) মিলনায়তনে ‘সমুদ্র রক্ষা, পুনর্গঠন ও টেকসই ব্যবহারের জন্য সমুদ্রসাক্ষর জাতি গঠনে গুরুত্ব’ শীর্ষক সেমিনারে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা এমন কথা বলেছেন। সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পাঠ্যপুস্তকে সমুদ্র সংক্রান্ত কোনও বিষয় পড়ানো হয় না। অনেকে সাগর দূষণ কথাটাও মানতে নারাজ। অথচ আমাদের অজ্ঞতার কারণে সৃষ্টিকর্তার এমন অমূল্য দানের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও মৎস্য অনুষদের ডিন ড. বাশেদউন্নবী রাফি ও নৌ-বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত চিফ হাইড্রোগ্রাফার শেখ মাহমুদুল হাসান।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সমুদ্র সংক্রান্ত জ্ঞান প্রচারকারী সংগঠন অক্টোফিনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ সেমিনারে অতিথি হিসাবে আরও বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল আলম, সহকারী অধ্যাপক ড. মো. সাইদুল ইসলাম সরকার ও ড. এনামুল হক।
সেমিনারে বিজ্ঞানীরা সমুদ্র দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরের পানিতে নানা ধরনের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা জানান, সমুদ্র রক্ষায় একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সমুদ্র দূষণ বন্ধে পর্যটন এলাকায় ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধেরও পরামর্শ দেন তারা।
সেমিনারে পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে গত ২ বছর ধরে কক্সবাজার উপকূলে কাছিম আসছে না বলে জানান নেকমের ব্যবস্থাপক সমুদ্র বিজ্ঞানী আবদুল কাইয়ুম। ড. ওয়াহিদুল আলম সাগরের পানিতে মাইক্রোবায়াল পলিউশন বা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া দূষণ বেড়ে যাওয়ার কারণে পর্যটন শিল্পও হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন।
এদিকে ২০৪৫ সালের মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে। দ্বীপটিতে প্রবাল ছাড়াও রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কচ্ছপ, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন প্রজাতির পাখিসহ নানা ধরনের প্রাণী। প্রতিনিয়ত পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়ে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাটির বিপর্যস্ত অবস্থা।
মার্কিন এক গবেষকদল বলছে, ১৮ শতক থেকেই কার্বনের দূষণ প্রভাব ফেলছে সমুদ্রপৃষ্ঠে। তাই ২১০০ সাল নাগাদ দূষণ কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে, তা সহজেই অনুমেয়। গবেষণার জন্য পৃথিবীর সমুদ্রের জলবায়ুতে কার্বন দূষণের অবস্থাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। গ্রিনহাউসের কারণে বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়ছে, শিল্পায়নের কারণেও বাড়ছে সমুদ্রের পৃষ্ঠের পানির উষ্ণতা আর অ্যাসিডিটি বা অম্লতা।
এই হারে যদি জলবায়ু পরিবর্তন হয়, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ আর সামুদ্রিক প্রাণীদের বসবাসের উপযোগী থাকবে না। ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত দূষিত হবে সমুদ্রপৃষ্ঠ। সুইজারল্যান্ডের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, ২০৪৮ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি মোট জিডিপির ১০ শতাংশ হারাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। দ্রুত কোনো পদক্ষেপ না নিলে এশিয়ার দেশগুলোর মোট জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আনন্দবাজার/শহক