শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীতে নিয়োগকালে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্ত্রীদের জন্য যোগদানের সুযোগ পায়না বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পাশকরা গ্রেজুয়েটরা। কারণ, নিয়োগে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্ষমতা আর টাকার দাপটে প্রশাসনের বড় বড় পদ হাতিয়ে নিয়েছেন কতিপয় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ উদ্দিন আহমেদের সময় অভিজ্ঞতায় ভূয়া সনদে চাকরি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রকৌশল জনাব জয়নাল আহমেদ চৌধুরী’র বিরুদ্ধে।
শাবিপ্রবির সীমানা প্রাচীরের কাজে অনিয়ম নিয়ে প্রকৌশল দপ্তরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর এবার সবার আঙ্গুল সহকারী প্রকৌশলী জনাব জয়নাল এর দিকে।
অনেকের অভিযোগ, প্রকৌশল দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা সুকৌশলে উপাচার্যের অগোচরে এসব অনিয়ম করে থাকে আর এই অনিয়মের মূলহোতা ও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জয়নাল আহমেদ চৌঁধুরী মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। এই জয়নাল আহমেদ চৌঁধুরী বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অভিযোগের কিছু নমূণা তুলে ধরা হল –
০১। তিনি নামসর্বস্ব একটা কম্পিউটার দোকানের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশল পদে চাকরী হাতিয়ে নেন। তার অভিজ্ঞতার সনদে দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে ঐ নামের কোন প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায় নি এবং কোনো প্রতিষ্ঠান অতীতে ছিল কি না এরকম কোন তথ্যও দিতে পারেন নি। এছাড়া অভিজ্ঞতা সনদের ওই কাগজে কোনো প্রতিষ্ঠানের স্মারক নাম্বার ও পাওয়া যায় নি।
০২। চাকুরির সময়ে তিনি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করা অবস্থায় তিনি ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনীতি করে যাচ্ছে প্রকাশ্যে, যা তার ফেসবুক টাইমলাইনই যথাযথ প্রমাণ করে। জনমনে প্রশ্নহল, সরকারি চাকরি করে আদৌ সক্রিয় রাজনীতি করার সুযোগ আছে কি-না। দেখা যায় জাতীয় দিবসগুলোতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচীতে না এসে সিলেট জেলা-মহানগর নেতাদের সাথে কর্মসূচী পালন করে থাকেন। বিগত বছর গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ জাতীয় দিবসে প্রকৌশল দপ্তরের সবাই উপস্থিত থাকলেও পাওয়া যায়নি এই জয়নাল আহমেদ’কে। এমন ঘটনায় তার উর্ধ্বতন মহল কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও কোনো উত্তর দেয় নি জয়নাল আহমেদ।
৩। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সাথে অসদাচরণ ও ক্ষমতার দাপট দেখানোর অভিযোগ অনেক পুরনো। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের(রাজনৈতিক নেতা/সংসদ সদস্য) বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রদের ঠেলে তার কাছাকাছি গিয়ে ছবি তুলার চেষ্টা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় সমাবর্তন এর একটা ছবিতে দেখা যায়, তিনি(জয়নাল) সব সিনিয়র কে পিছনে ফেলে রাষ্ট্রপ্রতির সাথে হাস্যজ্বল মুখে ছবি তোলার আপ্রাণ চেষ্টা তার। অবশ্য ছবি তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরক্তি জয়নাল গায়েই মাখেন না। একটা ছবিতে দেখা যায়, উনি রেজিস্ট্রার কে কুনই দিয়ে সরিয়ে উপাচার্যের কাছে এসে ছবি পোজ দিয়েছেন, এসময় ভিসি তাঁর দিকে বিরক্ত হওয়া মনোভাব নিয়ে তাকালেও জয়নাল সাবলীল ভঙ্গিতেই ছবি তুলে, সে ছবি নির্লজ্জভাবে নিজেই পোস্ট করেছেন। অবশ্য এসব ছবি তার সুবিধা নেওয়ার উত্তম হাতিয়ার। যেমনটা হাসপাতাল ক্যালেঙ্কারীতে সাহেদ করেছিলো।
তিনি কথায় কথায় বলেন, ‘আমি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ২ নম্বর সহ-সভাপতি এবং মাসুক উদ্দিন ও নাসির উদ্দিন খান খুব কাছের মানুষ। আমাকে কেউ কিছু করার ক্ষমতা রাখে না।’ এই দাপট দেখিয়েই চাকরি পাওয়ার পর থেকেই তিনি আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধচারণ করে যাচ্ছেন এবং নির্বাচনের সময় জামাত-বিএনপি হয়ে প্রকাশ্য প্রচারণা করে থাকেন। অথচ উনি সুবিধা নেন আওয়ামীলীগের আর কাজ করে জামাত-বিএনপির হয়ে। এই জয়নাল আহমেদ চৌঃ যে অতিরিক্ত জামাত ঘেষা তা তার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম্ম কিছু বিবরণ দেখলেই স্পষ্ট।
৪। তিনি সাবেক ভিসি আমিনুল হক ভূঁইয়ার সময় ক্ষমতার দাফটের কারণে যোগ্যতা পূরণ না করেই টাইমস্কেল হাতিয়ে নেন।
৫। এই জয়নাল বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মুজতবা আলী হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারদের একজন। কিন্তু কাজ চলাকালীন সময়ে কয়েকদিন সরেজমিননে গিয়ে গিয়ে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং কেউ তার সম্পর্কে এ’বিষয়ে কেউ কোন তথ্যও দিতে চাননি। এছাড়া তাঁকে ক্যাম্পাসের ছাত্রনেতাদের সাথে বসে একান্ত আলাপ করতে অনেকদিনই দেখা গেছে। বিশেষ করে সাবেক ভিসি আমিনুল হক ভূঁইয়ার সময়ে তিনি তৎকালীন নেতাদের সাথে নিয়মিত ফুটকোর্টের সামনে সাইট-অফিস বাদ দিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় মগ্ন থাকতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইসলামসবুজ এর সাথে তার সম্পর্ক ছিলো দহরম-মহরম। গোপন সূত্রে পাওয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডারসংক্রান্ত যাবতীয় গোপন তথ্য তিনি সবুজকে দিতেন, বিনিময়ে আর্থিকভাবে সুবিধা নিতেন। তার টাইমলাইনে দেখা যায়, সবুজ তাঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন কাছের ছোট ভাই।
এত অপকর্ম করে গেলেও ভয়ে এসব বিষয়ে প্রকৌশল দপ্তরের সিনিয়ররা তাকে কিছু বলার সাহস পান না এবং মুখ ও খুলতে চায় না। কারণ, তার ঐ যে সাবেক ২ নম্বর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ‘মাসুক ভাই’ ও ‘নাসির ভাই’ নামে তার মুখের বুলি।
এরকম আরো অসংখ্য অভিযোগ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহকারী প্রকৌশলী জনাব জয়নাল আহমেদ চৌঁধুরী’র বিরুদ্ধে।
সার্টিফিকেট জালিয়াতি, আর্থিক বিবরণী না মিলানো, ছাত্রীদের থেকে জোড় পূর্বক টাকা আদায়, ছাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা সহ এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীহলের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
ঠিক একই ধরণের অভিযোগ (যানবাহনের মেরারত খরচ বেশি নেয়া, তেল বিক্রি, পার্টস বিক্রি ইত্যাদি) পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন দপ্তরের কিছু কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে।
সহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আহমেদ চৌধুরী এর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি ফোনে কিছু বলতে চাচ্ছি না, কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।’ এছাড়া তিনি প্রতিবেদককে ব্যক্তিগতভাবে দেখার করারও কথা বলে।
শাবিপ্রবি হিসাব পরিচালক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ কর্মকর্তা পরিষদ এর সভাপতি আ.ন.ম. জয়নাল আবেদিন জানান, সহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আহমেদ চৌধুরী তার সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত না এবং কার্যক্রমেও সক্রিয় না। তাই তার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামাত সম্পৃক্ততার যেসব অভিযোগ এসেছে তা সে সামনাসামনি দেখেনি তবে তার ধারণা এসবে সে গোপনে সংযুক্ত থাকতে পারে।
আবার ভিন্ন ধরণের অভিযোগ উঠেছে জয়নুল ইসলাম এর বিরুদ্ধে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং বিএনপি-জামাত সমর্থিত কর্মকর্তা পরিষদের আহবায়ক।
গত ৭ নভেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ – আইইবির সিলেট কেন্দ্রের নতুন কমিটির অনুমোদন প্রদান করে। সিলেট কেন্দ্রের ২০২০ -২০২২ মেয়াদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন শাবিপ্রবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জয়নুল ইসলাম চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা যদি বাহিরের কোনো প্রতিষ্ঠানের পদ নিতে চায় তাহলে তা পূর্বেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি নিতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোসলেহ উদ্দিন তার দূর সম্পর্কের মামা হওয়ায় এই জয়নাল আবেদিন চৌধুরীর তার আপন ভাই ইমরান আহমেদ চৌঃ কে পরিবহন দপ্তরের কর্মকর্তা ও কাউছার আহমেদ চৌঃ কে আইআইসিটি দপ্তরের কর্মকর্তা সহ তার আত্মীয়সজন থেকেই প্রায় ১৫-২০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী নেয়। এদের মধ্যেও কয়েকজনের বিরুদ্ধে আবার সনদ জালিয়াতির ও অভিযোগ আছে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী জনাব হাবিবুর রহমান ও বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার ইশফাকুল ইসলাম কে একাধিকবার ফোন দিয়েও ফোনে পাওয়া যায় নি।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, ‘যদি এমন অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আমরা কর্মকর্তা সমিতি থেকেও সর্বদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষেই থাকবো।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কেউ যদি কোনো প্রকার জালিয়াতির আশ্রয় নেয় আর তা প্রমাণিত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
আনন্দবাজার/শাহী/দেলোয়ার