প্রয়োজন যেখানে জীবন সেখানে, হয় সেখানে জীবনের আয়োজন- এ যেন পৃথিবীর মানুষের চিরাচারিত অভ্যাস। চিন্তা-ভাবনা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক এই দুই ধরনের শিক্ষার মাধ্যম দিয়ে মানুষ পুরো জীবন অতিবাহিত করে। সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা ও নতুন কিছু আবিষ্কার এবং দেশ, সমাজ তথা রাষ্ট্র, বিশ্বের ইতিবাচক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে জীবনের অনেকটা সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ব্যয় হয়।
গুণগত শিক্ষার উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীরা গ্রাম থেকে জেলা শহর, জেলা শহর থেকে বিভাগীয় শহরের দিকে অগ্রযাত্রা করে। কখনোবা দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বাইরের রাষ্ট্রেও যাওয়া হয়। তেমনই উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসে প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষা দিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম একঝাঁক নবীন।
আমরা ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়টির এগারতম আবর্তন। একদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারার আনন্দ অন্যদিকে নতুন জায়গা, অচেনা পরিবেশে নিজেদের আবিষ্কারের ভয়, উৎকণ্ঠা ভর করে বসেছিল। কিন্তু প্রথম ক্লাসেই বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সিনিয়রদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে পড়ি।
অচেনা জায়াগা, অজানা মানুষ হওয়া সত্বেও মনে হতে শুরু করলো; আমরা কোন এক মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ। কে কোথায় থাকবো, কিভাবে পড়াশুনা করবো, কোন পথে গেলে ভালো হবে আবার কোন পথে যাওয়া অনুচিত -এ জাতীয় সবকিছু সিনিয়র ভাইয়া-আপুরা সহোদরের মতো দেখিয়ে দিলো। যে কোন কাজে হেল্প লাগলে আন্তরিকতার সাথে জুনিয়রদের পাশে আসা যেন সিনিয়রদের গুরু দায়িত্ব। এক এক করে কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র, শুভাকাক্সক্ষীর সংখ্যায় আশপাশ ভরে গেল। কয়েকদিনের মধ্যেই উৎকন্ঠা, ভয়েরা বিদায় জানিয়ে মনে হওয়া শুরু করলো-এইতো আছি বেশ। ক্যাম্পাসটাকে মনে হতে লাগলো আপন হাতে গড়া সুখ রাজ্যে। এখানকার প্রতিটি ছেলে-মেয়েই অনন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আনন্দের মুহুর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সময় হলো গণরুমের জীবন। এই গণরুমে থেকেই বুঝতে শিখি; প্রতিটি মানুষই সম্ভাবনাময়, উপযুক্ত পরিবেশ আর সহযোগিতা পেলে প্রত্যেকে তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। গণরুমের কেউ গান গাইয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখতো কেউবা স্বরচিত কবিতা আবৃতি করে শুনাত। আবার কেউ দেয়ালে আর্ট করতো। গণরুমের প্রতিটি দিন ছিলো ইদের দিনের মতো আনন্দময়।
পড়াশুনা বাদে বাকিটা সময় কাটতো আড্ডাবাজি করে। রাত তিনটে-চারটে সময় ঘুমাতে যেতাম। সকালে যার যখন ক্লাস থাকতো তার ঠিক পনের-বিশ মিনিট আগে জেগে জটপট রেডি হয়ে ডিপার্টমেন্টের দিকে দৌড়াতাম। যার চোখে যে শার্ট,প্যান্ট,জুতো পছন্দ হতো তাই পরিধান করে ছুটে যাওয়া হতো। একেবারে শেষে যে ঘুম থেকে উঠতো তাকে প্রায়ই সেন্ডেল পড়ে ক্লাসে যেতে হতো। ব্যাপারগুলো বাহির থেকে দেখলে বিদঘুটে মনে হলেও এগুলোই হলো গণরুমের সৌন্দর্য, ভ্রাতৃত্ব, একসাথে পথ চলা।
আমাদের গণরুমের নাম দিয়েছিলাম ‘গণ ভবন’। গণ ভবনে কেউ কোনদিন ইচ্ছে করেও মন খারাপ করে রাখতে পারতে না। একে অপরকে বন্ধু হিসেবে জানতাম। কেউ বিপদে পড়লে সবাই তাকে বিপদমুক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যেতাম। একটা সময় পর আমরা ভিন্ন ভিন্ন রুমে স্থানান্তরিত হই। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তার সিকিও কমেনি।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা বছর জুরে নানান আন্ত ডিপার্টমেন্ট টুর্নামেন্ট, আন্ত ব্যাচ টুর্নামেন্টের সুবাধে শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী-শিক্ষকগণের মাঝে আন্তরিকতা, ভ্রাতৃত্ব, হৃদ্যতা গড়ে উঠে। এভাবে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠে একটি পরিবারের মতো। পরিবারে যেমন কেউ নিজেকে একা মনে করে না তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় নামক পরিবারটিতেও কেউ একা নয়। কেউ সমস্যায় পড়লে বিভাগের বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রশাসন সমস্যা উত্তোরনে একযোগে কাজ করে। সমস্যা উত্তোরণে অর্থের পরিমাণ কোন ব্যাপার নয়, অর্থের যোগানে আমরা ঝাপিয়ে পড়ি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
এখানে জীবন বৈচিত্র্যময় সুন্দর। নিয়মিত ক্লাস,ক্লাস টেস্ট, আড্ডা, বন্ধুদের সাথে চায়ের কাপে ঝড় তোলা এখানকার নিত্যকার রুটিন। পড়াশুনার পাশাপাশি যার পছন্দের প্লাটফর্ম; ফটোগ্রাফি, চিত্রাঙ্কন, স্কাউিটং, বিএনসিসি, সাহিত্যের আড্ডা, থিয়েটার, বিতর্ক এরকম নানান সৃষ্টিশীল প্লাটফর্মের কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সবসময় প্রাণবন্ত থাকে।
বলা হয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন হলো ক্যাম্পাসের প্রাণ।করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে গত ১৬ মার্চ থেকে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ। প্রাণবন্ত ক্যাম্পাস এখন কোলাহল মুক্ত, নেই কোন ব্যস্ততা, বিভাগ-হলের সিঁড়িগুলিতে নেই বিরামহীন পায়ের আওয়াজ।
ক্লাস শেষে মনোযোগী বান্ধবীটির হ্যান্ড নোট নিয়ে টানাটানি কিংবা শীটের জন্য ফটোকপির দোকানে ভীড় করা হয় না।রাত বেরাতে নিশাচর প্রাণির মতো ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়ানো হয় না। শহিদ মিনার, বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য, লালন চত্বর, বাবুই চত্বর, কাঠাল তলা, সানসেট ভ্যালিতে প্রতিদিন কখনো আড্ডা কখনোবা বেসুরা কন্ঠের দলীয় গানে মেতে থাকা হয় না আজ প্রায় আট মাস ধরে। বাস্তবের সেই রঙ্গিণ দিনগুলো এখন স্মৃতি হয়ে মনের ক্যানভাসে ছবি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। রঙ্গিণ সেই দিনগুলোর স্মৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়ে অবচেতন মন বলে উঠে; আাবার কবে ফিরবো সেই ক্যাম্পাসে?
নুরুদ্দিন আহমেদ
শিক্ষার্থী;লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।