শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস, কি ঘটেছিলো সেদিন! 

১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর। দিনটি ছিলো মঙ্গলবার। সেনা শাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অগণতান্ত্রিক শাসনবিরোধী আন্দোলন তখন বেগবান। ছাত্ররা প্রতিবাদে উত্তপ্ত করে রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

চিত্তবিনোদনের জন্য টিভি চ্যানেল হিসেবে বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশনই ছিল তখন একমাত্র অবলম্বন। প্রতি মঙ্গলবারের মতো বিটিভিতে সেদিনও ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক নাটক ‘শুকতারা’। জগন্নাথ হলের তৎকালীন অনুদ্বৈপায়ন ভবনের টেলিভিশন কক্ষে রাত সাড়ে ৮টায় আরম্ভ হয় নাটক । এ সময় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপজনিত কারণে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে দমকা হাওয়া বয়ে যায় ও প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয়। ভবনটির ছাদ বৃষ্টির পানিতে নরম হয়ে যাওয়ায় পূর্ব থেকেই বৃষ্টির পানি পড়ছিল। সে কারণে ভবনে মেরামতের কাজ চলছিল। এর মধ্যেই দু-চারজন করে প্রায় চার’শ ছাত্র এলে টেলিভিশন কক্ষ ভরে ওঠে।

তখন রাত পৌনে ৯টা, অকস্মাৎ ভবনটির ছাদ ধসে পড়ে। যারা ভেতরে জায়গা না পেয়ে দরজা বা জানালার ধারে বসে নাটক দেখছিল, তারা দৌড়ে বের হতে পারলেও অধিকাংশ ছাত্রই সেদিন ছাদচাপা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং চাপা পড়া ছাত্রদের আর্তচিৎকারে জগন্নাথ হলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই হলের অন্যান্য ভবনের ছাত্র এবং খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ আর্তদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। একে তো টিপটিপ বৃষ্টি, অন্যদিকে বিদ্যুতহীন অবস্থা—এই প্রতিকূল পরিবেশে সারা রাত উদ্ধারকাজ তেমন এগোতে পারেনি। উদ্ধারকৃতদের এক হাসপাতালে স্থান দেওয়া সম্ভব না হলে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মাইকে তখন রক্তদান করার জন্য করুণ আকুতি ঘোষিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং বহু সাধারণ মানুষ এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাসপাতালে চলে যায় রক্ত দিতে। তার পরও সব জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুনঃ  ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক জুড়েই ময়লা আবর্জনার ভাগাড়

সেদিন ঘটনাস্থলেই মারা যান জগন্নাথ হলের ৩৮ ছাত্র-কর্মচারী-অতিথি । পরে তাদের উদ্ধার ও সেবা করতে গিয়ে আরো দু’জন মারা যান। নিহতদের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন ছাত্র, ১৩ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ও অতিথি। আহত হয় শতাধিক। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছে চিরতরে।

এই দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় পনেরো ও সাতদলীয় ঐক্য জোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা। বিদেশি কূটনীতকরাও শোক জ্ঞাপন করেন। তিন দিন জাতীয় শোক ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে ১৬ অক্টোবর সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই দিনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

এই ঘটনায় নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে পরবর্তী সময়ে এখানে নির্মিত হয় “অক্টোবর স্মৃতিভবন”। তাদের স্মরণে অক্টোবর ভবনের নিচতলায় একটি ছোট জাদুঘর আছে। সেদিনের ব্যবহৃত টিভি রাখা আছে এই জাদুঘরে। মৃত্যুবরণ করা বেশ কয়েকজনের ছবিও আছে সেখানে। এছাড়া ভবনটির সামনে নিহতদের স্মরণে তাদের নাম সংবলিত একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল এলাকায় আজ যেখানে ‘অক্টোবর স্মৃতিভবন’ দাঁড়িয়ে আছে, ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে ছিল অন্য একটি স্থাপনা। একে বলা হতো ‘পরিষদ ভবন’। এটাই ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ ভবন অর্থাৎ আজকের সংসদ ভবন। ১৯৪৭ সাল থেকে এখানেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসত। একে ‘অ্যাসেম্বলি হল’ও বলা হতো। নতুন প্রাদেশিক ভবন নির্মিত হলে ১৯৬৩ সালে এই ভবনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছাত্রদের আবাসিক প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ হলের সঙ্গে যুক্ত করেন।

আরও পড়ুনঃ  উচ্চশিক্ষার ভর্তিতে সহায়তার আবেদনের সময় বাড়ল

সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হলের কর্মচারী সুশীল দাস। তিনি এখনো চাকরিরত আছেন। ঘটনাক্রমে সেদিন এক ছাত্রকে সিট ছেড়ে দিয়ে সামনে গিয়ে বসায় সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। বর্তমানে তিনি অক্টোবর স্মৃতিভবনের নিচতলায় একটি ছোট দোকান চালান। তিনি বলেন, আমার ছেড়ে আসা সিটে বসা এক ছাত্র সেদিন মারা গিয়েছিল। আমি ওখানে বসা থাকলে হয়তো আজ আর বেঁচে থাকতাম না। আমি চেয়ারে বসা ছিলাম। এক ছাত্র এলে আমি চেয়ার ছেড়ে তাকে দিয়ে সামনে চৌকিতে গিয়ে বসি। এর মিনিট খানেকের মধ্যেই হঠাৎ এক বিকট শব্দে ছাদ ভেঙে পড়ে। পুরো টিভি কক্ষ ধুলোয় অন্ধকার হয়ে যায়। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।

ঘটনার পরের দিন সকালের অবস্থার কথা বর্ণনা করে হলের দ্বারপ্রহরী বিমল চন্দ্র রায় বলেন, হলের মাঠে সারি বেঁধে লাশগুলো রাখা হয়েছিল। নিহতদের আত্মীয়স্বজনের আহাজারিতে হলের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল। পুরো ক্যাম্পাস নিঃস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। মানুষের এত ভিড় হয়েছিল যে, পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে তাদের। আহতদের স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়ার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। এমনকি মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য রিকশাচালকরাও ভাড়া চাইতেন না।

জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি তখন মাস্টার্সের ছাত্র। সেদিন আমারও শুকতারা নাটক দেখতে যাওয়ার কথা ছিল, তবে পরদিন পরীক্ষা থাকায় আমি টিভি রুমে নাটক দেখতে যাইনি। যারা দেখতে গিয়েছিল তাদের যে করুণ পরিণতি হয়েছে তা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

আরও পড়ুনঃ  বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় সামিল হতে দেশে একটি বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন

প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচী আয়োজনের মাধ্যমে দিনটিকে স্মরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । তারই ধারাবাহিকতায় এবছরও বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন সম্পন্ন করেছে কতৃপক্ষ ৷ কর্মসূচির মধ্যে ছিলো সকাল ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান ভবন, সব হল এবং হোস্টেলে কালো পতাকা উত্তোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও কালোব্যাজ ধারণ, সকাল সাড়ে ৭টায় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও সামজিক দূরত্ব বজায় রেখে জগন্নাথ হল স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও নীরবতা পালন, সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে জগন্নাথ হল প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা, ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা সভা এবং বাদ আসর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিআ’সহ সব হল মসজিদে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত।

এদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস’ উপলক্ষে নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ‘স্মৃতি অক্টোবর’ স্মারক স্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ।

আনন্দবাজার/শাহী/মনির

সংবাদটি শেয়ার করুন