শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনায় অনলাইন ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা

বৈশ্বিক মহামারি করোনা প্রভাব বিস্তার করেছে গোটা পৃথিবী জুড়েই। আক্রান্ত করেছে লাখ লাখ মানুষকে। কেড়ে নিয়েছে অজস্র প্রাণ। বাংলাদেশেও এই মহামারি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশে ২৬ মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হয়ে কয়েক দফা বাড়ানো হয়। যদিও মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। দিন দিন বাড়ছে আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যা। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকার বাধ্য হয়েই লকডাউন তুলে নেয়। ৩০ মে লকডাউন শেষ হলে সীমিত পরিসরে চালু করা হয় অফিস, আদালত ও গণপরিবহন। কিন্তু বন্ধ রাখা হয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

শিক্ষার্থীদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ সরকার ও ইউজিসির নির্দেশনায় চালু হয়েছে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শুরু হয় অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ঢাবি, জবি, রাবি, জাবি শিক্ষার্থীদের ভাবনার কথা জানার চেষ্টা করেছেন – মামুন শেখ ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহমিদা হায়দার তিথী বলেন, গতবছর ও যেই শব্দ সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণা ছিলো না আজ সেই শব্দ শুনলেই মানবমন শিওরে উঠে। “করোনা ভাইরাস” শব্দটি রীতিমতো মানবমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।করবে নাই বা কেন! এ যে মরণব্যাধি।সারাবিশ্ব যখন স্থবির হয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান প্রক্রিয়া ব্যহত তখন প্রযুক্তি আমাদের নতুন দিগন্তের হাতছানি দিচ্ছে। এই করোনাকালীন সময়ে আমাদের যে সকল বিধিনিষেধ মেনে চলতে হচ্ছে তার মধ্যে সামাজিক দূরত্ব অন্যতম। এই সামাজিক দূরত্বের কথা মাথায় রেখেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ এবং ঢাবি প্রশাসন আমাদের অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।যথাসময়ে আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছে এবং নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে।সবথেকে বড় কথা হলো এই দুর্যোগকালীন সময়ে আমরা যে পড়া থেকে ছিটকে গিয়েছিলাম সেই ধারায় কিছুটা হলেও ফিরে এসেছি।ক্লাস করা মূল উদ্দেশ্য হলেও সেই সুযোগে বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে, হোক না সেটা ভার্চ্যুয়াল তবুও স্মার্টফোনের স্ক্রিনে যখন বন্ধুদের জীবন্ত ছবি ভেসে উঠে তখন কী যে ভালো লাগা কাজ করে বলে বোঝানো যাবে না! যদিও অনলাইন ক্লাসের ব্যাপার টা আমার কাছে মনে হয় দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মতো। তবুও শিক্ষকবৃন্দ কষ্ট করে আমাদের জন্য লেকচার তৈরি করেন এবং সেই লেকচার আমাদের সামনে তুলে ধরার পেছনে যে পরিমাণ কষ্ট করতে হয় তা শুধু একজন শিক্ষকই বলতে পারবেন।

আরও পড়ুনঃ  ইবি'র ২৬ শিক্ষক পাচ্ছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ

আমরাও যতোটা সম্ভব ক্লাসে মনোযোগ রাখার চেষ্টা করি। অনলাইন ক্লাসের ফলে এখন আমাদের পায়ে হেটে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যাওয়া লাগে না। এক জায়গায় বসে আয়েশ করে ক্লাস করে নিই।ক্লাসের ফাঁকে মাঝে মাঝেই মা এসে চায়ের কাপ হাতে তুলে দেন।আহ! কি আরাম। তবুও সীমাবদ্ধতা তো আছেই। আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশে ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে ক্লাস করার সামর্থ্য অনেকেরই নেই। অনেকের যে স্মার্টফোনও নেই।তাহলে তারা ক্লাস করে না! নাহ, তাদের ভাগ্যে ক্লাস করা হচ্ছে না।প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যারা ক্লাস করছে তারা নেটওয়ার্ক ভালো না পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ছে।ক্লাসের মাঝেই তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।অনেকের বাড়িতে যে বিদ্যুৎ সংযোগ মাঝে মাঝেই চলে যায়! তবুও অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে যতোদিন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় এবং আমরা কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ক্লাস করছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই আমরা প্রাণের ক্যাম্পাস মুখরিত করে তুলবো। সবাই একত্রে পূর্বের মতো শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসে ক্লাস করতে পারবো।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোঃ মামুন শেখ বলেন, বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি নির্দেশনায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ ইউজিসি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে যে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এ উদ্যোগ যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীদের একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া লেখাপড়ায় কিছুটা হলেও সংযোগ ঘটবে এবং করোনা পরিস্থিতির জন্য যে সেশন জট আশংকা করা হচ্ছে তা হয়তো রোধ সম্ভব হবে। তবে যাদের জন্য এত আয়োজন, সেই আয়োজনে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না সে দিকটাও বিবেচনায় রাখা দরকার বলে মনে করি। কারণ আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ভাই-বোন আছেন, যাদের প্রযুক্তি সামর্থ নেই। অধিকাংশই গ্রামে যাদের নেটওয়ার্ক পাওয়া নিয়েই অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেখানে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হওয়াটা একরকম কষ্টসাধ্য। এছাড়া বর্তমানে অনেক পরিবারেই দেখা যাচ্ছে আর্থিক সমস্যা। এসব পরিবারের জন্য এত উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে অনলাইন ক্লাসে যোগ দেয়া অসম্ভব। এমন পরিস্থিতে এ উদ্যোগ আশার মুখ দেখবে বলে মনে হয়না। আর যদি কার্যকর করাও হয়, তাহলে একটি বৃহদাংশ বঞ্চিত হবে।

আরও পড়ুনঃ  নির্মিত হচ্ছে শেখ রাসলকে নিয়ে সিনেমা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক বলেন, কোভিড-১৯ নামক অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে পরাস্থ গোটা পৃথিবীর মানুষজন। থমকে দিয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা সহ সকল কিছু। জনবহুল বাংলাদেশে করোনা সংক্রামণের তাগিদে গত ১৭মার্চ থেকে একযোগে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।দেশে করোনার সংক্রামণ বৃদ্ধি পাওয়াতে ধাপে-ধাপে বাড়ানো হয়েছে ছুটি। যার ফলে দীর্ঘ সময়ে বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেশনজট নিরসনকল্পে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চালু হয়েছে। যেখানে অংশ নিচ্ছে মাত্র ২০-৩০%শতাংশ শিক্ষার্থী। কেননা অধিকাংশ শিক্ষার্থী গ্রামে অবস্থান করছে।গ্রামে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা খুবই নাজেহাল। তাছাড়া অনলাইনে ক্লাস করার জন্য মেগাবাইট ক্রয় করাও সহজলভ্য নয়। সবমিলিয়ে দেখা যায় এই অনলাইন ক্লাস একটা বৈষম্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার ফলে ক্ষতির আশংকায় পড়তে হতে পারে এসকল শিক্ষার্থীর। একজন শহরের শিক্ষার্থী যে ফ্যাসিলিটিতে থাকে কিন্তু গ্রামে সে পরিবেশ পরিস্থিতি আছে কিনা অবশ্যই বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে হলে অবশ্যই সকল দিক বিবেচনায় রাখতে হবে। পরবর্তী করোনা পরিস্থিতি ওপর নির্ভর করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে কি না। আপাতত সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া কোন পথ দেখছি না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাকসুদ জুবায়ের বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দীর্ঘদিন ধরে দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে । শিক্ষার্থীদের ক্ষতির কথা বিবেচনা করে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে পাঠদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু অনলাইনে পাঠদানের সুফল শুধু শহরে, পিছিয়ে পড়েছে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা। প্রান্তিক অঞ্চলে নেটওয়ার্ক অনেক দুর্বল। ফলে অনলাইন ক্লাস করতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তাছাড়া অনলাইনে ক্লাস করার জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে যা অনেক শিক্ষার্থীদের পক্ষে বহন করা কষ্টকর। তবে শিক্ষার্থীরা এই নতুন আঙ্গিকে পড়াশোনা সত্যিই কতটা বুঝতে পারছে অথবা কতটা ঠিকঠাক শিখছে, তা নিয়ে রয়েছে প্রবল ধন্দ । মনে হচ্ছে অনলাইন ক্লাসে শুধু সিলেবাস এগুচ্ছে, শিক্ষা নয়। ক্লাসে পাঠদানের সম্পূর্ণ বিপরীত হল ভার্চুয়াল পদ্ধতি। এতদিন পড়ুয়াদের সঙ্গে সরাসরি বা সামনাসামনি পড়াশোনায় শিক্ষকরা যতটা স্বাভাবিক ছিলেন, হঠাৎ অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষাদানে তাঁরা প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন। বহু শিক্ষকই পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে সড়গড় নন। পড়ানোর আগে তাঁরা প্রস্তুতি নিয়ে আসতেন। এমনটাই তাঁরা করছেন দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু অনলাইন ক্লাসের আগাম কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই আচমকাই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বড় অংশ এই পদ্ধতিতে পড়াতে গিয়ে অসুবিধের মুখে পড়ছেন।

আরও পড়ুনঃ  ৬৭ বছর বয়সে এসএসসি

আনন্দবাজার/শাহী/মামুন

সংবাদটি শেয়ার করুন