ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রুশ বিজয় উৎসবে: তুষার আর কবিতার অশ্রুঝরা গান

মেট্রো-স্টেশন ‘ ফ্রুনজেনস্কায়া’ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে। আকাশে বসন্তের সূর্য। মূল ভবনের কাছাকাছি আসতেই রাজকীয় এক অভ্যর্থনায় শুভ্রতা ছড়ালো কোমল তুষারকণা। এ অভ্যর্থনা নিরর্থক নয়।

৯ মে, রাশিয়ায় বিজয় দিবস। মাতৃভূমির জন্য জীবন উৎসর্গকারী সব বীরদের স্মরণ করার জন্য আমরা একত্রিত হয়েছি। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় সাজানো হয়েছে সেন্ট জর্জ ফিতার কমলা ও কালো রঙে। স্থানে স্থানে রাশিয়ার ‘মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধ’ এর ইতিহাসের প্রদর্শনী। মহান বীরদের সাদাকালো ছবি। আমরা নিজেরাও সেজেছি সাদা-কালোতে আর হৃদয়ের কাছাকাছি পরিধান করেছি সেন্ট জর্জ রিবন।

আমাদের পরিচয় তখন আর কেবল বিদেশী শিক্ষার্থী নয়। বরং রাশিয়ার ইতিহাস আর সংস্কৃতির অনুরাগী। রাশিয়ার ঐতিহ্য আর ইতিহাস আমাদের হৃদয়ে। আমরা সে ইতিহাসকে উদযাপন করতে তৈরি।

বেশ কয়েকদিন ধরেই সঙ্গীতের মহড়া চলছিল। সাংস্কৃতিক পরিবেশনার বিষয়বস্তু যুদ্ধের প্রেক্ষাপট হলেও সেখানেও বৈচিত্র্য রয়েছে। বীর যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, কিংবা গৌরবগাঁথাই কেবল স্থান পায়নি। ছিল প্রেম আর শান্তির বার্তাও!
বিশেষ কিছু মানুষের বক্তৃতা দিয়ে শুরু হয়। এ বক্তৃতা কারও ক্লান্তির কারণ হয়নি। বরং এই মহান দিনটির বিশেষত্ব উপলব্ধি করার তৃষ্ণাকেই যেন বাড়িয়ে দেয়। আমাদের একটি চলচ্চিত্র দেখানো হয়, যেখানে খুব সহজ করে বলা হয় রাশিয়ার ‘মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধ’ এর ইতিহাস যাকে পুরো বিশ্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে জানে। দেখানো হয় স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান। রাশিয়ার জণগণের আত্মত্যাগ। সেই সঙ্গে গৌরবের বিজয়ক্ষণ।

এরপর বীরদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে কয়েক মুহূর্তের নীরবতা ছাপিয়ে শুরু হয় কবিতাপর্ব। প্রথমেই সুযোগ হয় আমার। এ কবিতায় রক্তপাত নেই। আছে কেবল মৃত্যুর নিবিড়ে থাকা এক সৈনিক। এবং তুষারের শীতলতায় প্রেমের উষ্ণতার উপলব্ধি। একটা হারমোনিকার সুর কেমন করে তার প্রিয় মানুষের চোখ আর হাসির কথা মনে করিয়ে দেয়।
‘জিমলিয়ানকে’ কবিতাটি যখন আবৃত্তি করছিলাম জানি না বাইরে তখনও তুষার পড়ছিল কিনা। তবু আলেক্সি সুরকভ (কবি) এর শব্দ, বড়পর্দায় উত্তাপ ছড়ানো আগুনের আবহ আর অপেক্ষমাণ দর্শকের নীরবতা আমার কণ্ঠকে যেন সেই সময়ে নিয়ে গেছে। যেন সৈনিক থেকে হয়ে উঠি এক প্রেমিক-

‘এই শীতল মাটির ঘরে, তোমার নির্মল প্রেমে আমি উষ্ণ হই।’
-না। বোধ হয় এক ভাষায় সৃষ্ট সৌন্দর্য অন্য ভাষায় রূপান্তর করে বোঝানো যায় না। প্রত্যেক ভাষার সৌন্দর্য ভিন্ন।
পরোক্ষণেই এই কবিতাটি সুরারোপে গান হয়ে আমাদের মোহিত করে। যুদ্ধের আবহে প্রেমের এই গান জীবনকে শিল্পের অনন্যতায় পৌঁছে দেয়।
এরপর আরও কবিতা আরও গান। পরিবেশনা করেন এমন শিক্ষার্থীরা যারা এখনও রুশ ভাষা শিখছেন। রুশ ভাষা বোধ হয় এমন এক ভাষা, যা শিখতে গেলে রাশিয়ান সংস্কৃতির সাথে নিবিড় না হয়ে থাকা যায় না।

এ আয়োজনে বিশেষ আকর্ষণ একটি সমবেত সঙ্গীত- ‘আত গিরোয়েভ বিলিখ ভ্রেমিওন’ (অতীতের বীরদের গান)- এ গানের কথায় রাশিয়ার বীরদের প্রতি অগভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। তারা কতটা দুঃসাহস আর প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গেছে সে সত্যই শোনানো হয়। কেবল তাই নয়, এ গানের কথা আর সুরে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বার্তা থাকে। যে বার্তা পূর্বসূরিদের ত্যাগ আর অবদানকে বৃথা না হতে দেওয়ার আহবানে শেষ হয়৷ সঙ্গীতশিল্পী নাইরা আসাতরিয়া আমাদের এ গানটি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধান করেছেন।

গানের শেষ দিকে সব দর্শক দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানান আমাদের, এক হয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন মহান বীরদের-
‘রাশিয়ায় এমন কোনও পরিবার নেই,
যেখানে মহান বীরদের স্মরণ করা হয় না’।
রাশিয়ার জনগণ দেশপ্রেমে দৃঢ় আর ভালোবাসায় উদার। আমার রুশ শিক্ষকরা বলেন, ‘রাশিয়া কখনও আক্রমনাত্মক নয়। কেবল নিজেদের প্রতিরক্ষা করে।’ তাই তো এ যুদ্ধের নাম ‘মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধ’।
পরিবেশনা শেষে ‘মালাজিয়েত্স!'(ভালো কাজ) কিংবা ‘অনেক খুশি হয়েছি তোমার পার্ফরমেন্সে’, ‘আমার কান্না পাচ্ছিল’ – শিক্ষক ও সহপাঠী বন্ধুদের এরকম প্রশংসায় সত্যিই কতখানি অধিকার আমার কিংবা আমাদের জানি না। তবে এমন আয়োজনে সম্পৃক্ত হয়ে মনে হচ্ছিল, নতুন করে একটা সংস্কৃতির ইতিহাসকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।
বাইরে বের হতেই আবার মিষ্টি রোদ। এই রোদ, এই তুষারপাত। যেন সকল বৈচিত্র্যকে আপন করে নেওয়ার উৎসব। ফিরতে ফিরতে ‘দিন পাবিয়েদি’ (বিজয় দিবস) চলচ্চিত্রটির শেষ বার্তাটা ভীষণ মনে হচ্ছিল- ‘আমরা যুদ্ধ চাই না’।
এই সুন্দর পৃথিবীতে সমস্ত যুদ্ধের অবসান হোক।
(লেখাটা আমার প্রিয় রুশ শিক্ষকদের জন্য।)

শারমিন সুলতানা

মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশনমস্কো, রাশিয়া।

সংবাদটি শেয়ার করুন