জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে মাদকের সক্রিয় সিন্ডিকেট,একে একে বের হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় নানা অপরাধ কর্মে জড়িত সংঘবদ্ধ দূর্বৃত্তদের নাম।
জাবি শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একটা অংশও গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গেও জড়িয়েছে তারা। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
সাম্প্রতিক ধর্ষণে অভিযুক্তদেরও মাদক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ এসেছে এই প্রতিবেদকের হাতে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে জয় এবং মামুনুরর রশীদ ওরফে মামুন মাদক সেবন ও কারবারে জড়িত। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অভিযোগকারী ও তার স্বামীর পূর্বপরিচিত ও তাদের বাসায় সাবলেট থাকতো। অভিযুক্ত মামুন (৪৫) একজন চিহ্নিত মাদক কারবারি দীর্ঘদিন ধরে মিরপুরের কল্যাণপুর বস্তিতে মাদক কারবারিতে জড়িত, জাবিতে মাদক সিন্ডিকেটের সাপ্লাই চেইনের অন্যতম হোতা।
পুলিশের অপরাধী তালিকায় ৪৫ বছর বয়সী মামুনের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানা, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া বগুড়া এবং কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় চারটি মাদক আইনে মামলার (ইয়াবা) তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে দুই মামলায় মামুন দুইবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছেন। প্রথমবার ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর মিরপুর মডেল থানায় দায়ের মামলায় মামুনকে আটক করা হয়। পরে ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি টেকনাফ থানার মামলায় তাকে আবারও গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জানা যায়, বহিরাগত মামুন মাদক ব্যবসা এবং সেবনের জন্য প্রায়ই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসতেন। সেখানে শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান জয় তাকে আশ্রয় দিয়ে মাদক ব্যবসা চালাতেন।
এদিকে মাদক সিন্ডিকেটে জড়িত ছাত্রলীগের বেপরোয়া অংশ হলে হলে গড়ে তুলেছে টর্চার সেল। শিক্ষার্থী নির্যাতন এবং চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ঘটনায় টার্গেট ব্যক্তিকে তুলে এনে এসব সেলে নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। তবে ভুক্তভোগীরা ভয়ে মুখ না খোলায় বেশিরভাগ ঘটনাই থেকে যায় আড়ালে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বেপরোয়া আচরণে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে জাবি ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বেপরোয়া অংশের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় কমিটিও। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভেঙে দেওয়া হতে পারে জাবি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয়কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, জাবি ছাত্রলীগের গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আমরা অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। আমরা কোনো ধরনের অনিয়ম-অপরাধকে প্রশ্রয় দেই না। যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের অপরাধী হিসাবে দেখি।
এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, জাবি ছাত্রলীগের একটা অংশ দুর্বৃত্তায়নে জড়িয়ে পড়েছে। কয়েকজন নেতার শেল্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক সেবনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে দিন-দুপুরে চলে মাদক সেবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বহিরাগতরা এদব মাদকের আসর জমায়। তাছাড়া আবাসিক হলগুলো হয়ে উঠেছে মাদক সেবনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা পার্শ্ববর্তী আমবাগান, গেরুয়া ও ইসলামনগর এলাকা থেকে তাদের অনুসারী বর্তমান কমিটির কতিপয় নেতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক সরবরাহ করে।
এই সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সবশেষ শিকার স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ ঘঠনা। মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনার নেপথ্যেও মাদক সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে।
মাদক ও ছিনতাই চক্রের কৌশল:
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাদক চক্রের সক্রিয় দৌরাত্ম্য রয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সাবেক বর্তমান ছাত্র ও বহিরাগতদের সমন্বয়ে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রণ হয় এই মাদক সিন্ডিকেট। কিন্তু মীর মশাররফ হোসেন হলে রয়েছে ভিন্ন সিন্ডিকেট কৌশল।এখানে অনেক দিন থেকে ব্যাচভিত্তিক ইয়াবা ব্যবসা চলে আসছে। প্রতিটি ব্যাচের এক বা একাধিক জন ইয়াবা ব্যবসার নেতৃত্ব দেন। সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচের যিনি ছাত্রলীগের নেতা তার হাতে থাকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ। তিনি প্রতিটি ব্যাচে কারা বাবসা করবে সেটি ঠিক করে দেন। আর তাদের সহযোগিতা করেন বহিরাগত কারবারিরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের একাধিক কর্মী বলেন, এই হলের মূল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন ৪৩তম ব্যাচের একজন ছাত্রলীগ নেতা। এরপর তিনি ৪৪,৪৫ ও ৪৬তম এই তিন ব্যাচের প্রতিনিধি নির্বাচন করে দিয়েছেন। তারাই বিভিন্নভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তাদের ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য ইয়াবা হলে আসার পর একটা নির্দিষ্ট ভাগ যায় নেতার কাছে। তারা আরও বলেন, ক্যাম্পাসে অন্য হলগুলোতে ইয়াবা ব্যবসা হয়, তবে সেটা ব্যাচভিত্তিক নয়। একমাত্র এই হলেই এমন হয়। হলের রাজনীতিতে সক্রিয় অনেক শিক্ষার্থী ইয়াবা সেবন করেন। আর ক্যাম্পাসে প্রায় প্রতিনিয়ত ২০০ ছাত্র নিয়মিত ইয়াবা সেবন করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত মোস্তাফিজও ইয়াবাসেবী। মামুনের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ইয়াবা ব্যবসাকেন্দ্রিক।
তবে এসব বিষয়ে অবগত নন উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেল বলেন, তার সংগঠন মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়েছে। কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় আইনে শাস্তি নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনার নেপথ্যে মাদক ব্যবসার লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্বের যোগসূত্র রয়েছে।’
এসময় ওই কর্মকর্তা আরও জানান, এমন অন্যকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে মাদক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, এমন অনেক ঘটনাই আছে যা নানা কারণে তাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
জাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, ‘কিছু কুলাঙ্গার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিশ্বপরিমণ্ডলে পদদলিত করেছে। আমরা এখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। পৈশাচিক এ ঘটনা ও মাদক সিন্ডিকেটের দৌরাত্ব কে বিছিন্ন ঘটনা বলে মনে করার সুযোগ নেই।বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব কর্মকাণ্ড জিরো টলারেন্স এ দমন করা উচিত। সরকারের কাছে আমি দাবি জানাই, এদের যেন প্রকৃত বিচারটা হয়।’
বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন: “জাবিতে ধর্ষণকান্ডে জড়িত মাদক কারবারি মামুনের তথ্যনুযায়ী, গ্রেপ্তারকৃতরা অনেকদিন থেকেই মাদক ব্যবসা করে আসছেন। ভিকটিমের বাসায় সাবলেট হিসেবে বসবাস করতেন। ভিকটিম ও তার স্বামীর সঙ্গে মামুনের ৩ বছরের অধিক সময় ধরে মাদক ব্যবসার সম্পর্ক রয়েছে। তারা একসঙ্গেই একই বাসায় থাকতেন। ভিকটিমের স্বামী মামুনকে মাদক ব্যবসায় সাহায্য করতেন।”
খন্দকার আল মঈন আরো জানান, “আমরা আগামী প্রজন্মকে জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার স্বপ্ন দেখি। এমনকি যারা মাদক কারবার, চোরাচালানসহ অবৈধ ব্যবসা করেন, সেই সব ব্যক্তিরাও খারাপ হলেও অভিভাবক হিসেবে নিজের সন্তানকেও বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করান। আমরা চাই আমাদের সন্তানরা লেখাপড়া করুক এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক।”