ঢাকা | সোমবার
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহারের অভিযোগ

ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহারের অভিযোগ

ভুয়া ডিগ্রি ব্যাবহারের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান মেডিকেল অফিসারের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে দন্ডিত হতে পারেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অফিসার ডা. হাফেজা জামান।

জানা যায়, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ডা. হাফেজা জামান পাবলিক হেলথ্ বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে। যা বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন (বিএমডিসি)-২০১০ কর্তৃক স্বীকৃত নয়। যে কারণে তিনি ৩ (তিন) বছর কারাদন্ড বা ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হতে পারেন।

বিএমডিসি আইন -২০১০ এর ধারা ১৩তে মেডিকেল চিকিৎসা-শিক্ষা যোগ্যতার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী বা ডিপ্লোমার স্বীকৃতি বিষয়ে উপধারা (১)-এ বলা হয়, ‘বাংলাদেশে অবস্থিত বা বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত কোন মেডিকেল প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত মেডিকেল চিকিৎসা-শিক্ষা যোগ্যতার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী বা ডিপ্লোমাধারী কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে উক্ত ডিগ্রী ব্যবহার করতে চাইলে, তা এই আইনের অধীন কাউন্সিল কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে।’

এছাড়া উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে অবস্থিত বা বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত মেডিকেল চিকিৎসা-শিক্ষা যোগ্যতার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী বা ডিপ্লোমা প্রদানকারী কোন মেডিকেল প্রতিষ্ঠানের নাম তৃতীয় তফসিলের, যথাক্রমে, “ক” অংশে বা “খ” অংশে অন্তর্ভুক্ত না থাকলে, উক্ত প্রতিষ্ঠানকে বা, ক্ষেত্রমত, উক্ত ডিগ্রীধারী ব্যক্তিকে এই আইনের অধীনে উক্ত যোগ্যতার স্বীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যে কাউন্সিলের নিকট আবেদন করতে হবে।’

এদিকে মেডিকেল চিকিৎসা- শিক্ষার স্নাতকোত্তর বা কোনো ডিপ্লোমা পরিচালনার অনুমতি নেই স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের। অর্থাৎ বিএমডিসি কর্তৃক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান নয় স্টেট ইউনিভার্সিটি।

এ নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা জানান, আমাদের এখান থেকে অনেক শিক্ষার্থী ডিগ্রি নিচ্ছে। তিনি যে ডিগ্রি নিয়েছেন, সেটির বিএমডিসির অনুমোদন নেই।

বিএমডিসির ধারা ২৯- এ ভুয়া পদবী, ইত্যাদি ব্যবহার নিষিদ্ধের বিষয়ে উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন নিবন্ধনকৃত কোন মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক এমন কোন নাম, পদবী, বিবরণ বা প্রতীক এমনভাবে ব্যবহার বা প্রকাশ করবেন না যার ফলে তার কোন অতিরিক্ত পেশাগত যোগ্যতা আছে মর্মে কেউ মনে করতে পারে, যদি না কেউ কোন স্বীকৃত মেডিকেল চিকিৎসা- শিক্ষা যোগ্যতা বা স্বীকৃত ডেন্টাল চিকিৎসা-শিক্ষা যোগ্যতা হয়ে থাকে। ন্যূনতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রী প্রাপ্তগণ ব্যতিত অন্য কেউ ডাক্তার পদবী ব্যবহার করতে পারবে না।’

যার সত্যতা মিলেছে ডা. হাফেজা জামানের ব্যাবহৃত নেমপ্লেটে। সেখানে হাফেজা জামানের যোগ্যতা হিসেবে, এমবিবিএস ( ব্যাচেলর অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি), সিসিডি (চার্জ কাপল্‌ড ডিভাইস) এবং এমপিএইচ (মাস্টার্স অব পাবলিক হেলথ্) ডিগ্রির উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি এমপিএইচ ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেছেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে। যার বিএমডিসির অনুমোদন নেই।
এ নিয়ে ধারা ২৯ এর উপধারা- (২) এ বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর বিধান লংঘন করলে উক্ত লংঘন হবে একটি অপরাধ। তার জন্য তিনি ৩ (তিন) বছর কারাদন্ড বা ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। এছাড়া উক্ত অপরাধ অব্যাহত থাকলে, প্রত্যেকবার অপরাধীকে পুনরাবৃত্তির জন্য অন্যূন ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থ দত্তে, বর্ণিত দন্ডের অতিরিক্ত হিসাবে দন্ডনীয় হবেন।’

সে হিসেবে হাফেজা জামান ৩ (তিন) বছর কারাদন্ড বা ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হতে পারেন।

জানা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ডা. হাফেজা। গত বছরের আগস্টে মেডিকেল সেন্টারের প্রধান মেডিকেল অফিসার পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে এমবিবিএস এবং যে কোনো অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর বা ডিপ্লোমা ডিগ্রি, শিক্ষাজীবনের সব পরীক্ষায় কমপক্ষে দ্বিতীয় বিভাগ এবং কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ১৫ বছরের পেশাগত দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। সেখানে স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে করা স্নাতকোত্তরের সনদ নিয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ডা. হাফেজা। পরবর্তীতে এনিয়ে শুরু হয় নানা আলোচনা- সমালোচনা। যা নিয়ে খবর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, প্রধান মেডিকেল অফিসার পদের জন্য মোট ১৭ জন আবেদন করেন। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রধান মেডিকেল অফিসার পদে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান মেডিকেল অফিসার ডা. হাফেজাকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করে সিলেকশন বোর্ড।
যদিও তাকে নিয়োগের ব্যাপারে বোর্ডের বেশ কয়েকজন সদস্য সে সময় দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। কারণ হিসেবে তারা ওই প্রার্থীর ডিগ্রির বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) অনুমোদন না থাকাকে উল্লেখ করেছেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিকেল সেন্টারের এক চিকিৎসক বলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) অনুমোদন না থাকলে, প্রাইভেট বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিগ্রি গ্রহণযোগ্য নয়। যদি কেউ এমন ডিগ্রি নেয়, তাহলে তা ভুয়া বলে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে এসকল ডিগ্রি ব্যক্তিগত কার্ড বা অফিসিয়াল নেমপ্লেটে ব্যবহার করতে পারবে না, আইন অনুযায়ী।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকদের অভিভাবক বিএমডিসি। সুতরাং প্রত্যেক চিকিৎসকের উচিত এই আইন মেনে চলা।

বিএমডিসির সহকারী রেজিস্টার ডা. মো. আনওয়ারুল হক ফারাজি সোহেল বলেন, তিনি যদি ডাক্তার হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই বিএমডিসির এ্যাপ্রুভাল লাগবে।

এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. শাহরিয়ার নবী বলেন, কোনো ডিগ্রিকে ভুয়া বলার সুযোগ নাই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পারমিট করে এবং ওনি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছে সেটাকে তো ভুয়া বলা যায় না। কারণ ওই বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি এবং সরকার কর্তৃক স্বীকৃত। তবে ওই ডিগ্রি বিএমডিসি কর্তৃক স্বীকৃত নয়। এদিকে মেডিকেল সেক্টরে ডিগ্রিটা কোথায় থেকে নিয়েছে এবং সেটা বিএমডিসি স্বীকৃত কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

ডা. শাহরিয়ার নবী বলেন, ওই ডিগ্রিটা (পাবলিক হেলথ্) মেডিকেল প্রফেশনে কাজ লাগবে না। ওনি যদি কোন এনজিও অবথা পাবলিক হেলথ্ সেক্টরে কাজে লাগাতে পারে তাহলে করতে পারবে।
কিন্তু ডা. হাফেজা জামান ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসারের নেমপ্লেটে ওই ডিগ্রি ব্যাবহার করছেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা অনৈতিক। এটা যদি করে থাকে সেটা তার করার কোনো সুযোগ নাই। তার কারণ বিএমডিসির স্বীকৃত ডিগ্রি ছাড়া এ জায়গায় অন্য কিছু ব্যবহার করতে পারবেন না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিষয়টা প্রফেশনালের সাথে জড়িত; ওনারা ভালো বুঝবেন। না ব্যবহার করতে না পারলে তো করবেন না। ওনার (হাফেজার) সাথে কথা বলেন, ওনি ব্যবহার করে কিনা। আমরা তো ডিগ্রিও দেই নাই। আর ওই ডিগ্রি দিয়ে কোথাও বিবেচনায়ও রাখি নাই। কোনো অসঙ্গতি থাকলে ওনাকে ব্যাখ্যা দিতে বলেন।
তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ডা. হাফেজা জামানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও পাওয়া যায় নি এবং পরবর্তীতে অফিসে গিয়েও পাওয়া যায় নি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন