কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার বিপরীতে প্রযুক্তির কল্যাণে আর আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি যুক্ত হওয়ায় বাড়ছে উৎপাদন। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর আকস্মিক বন্যায় প্রায়ই ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। এতে অনিশ্চয়তায় পড়ছে কৃষক। এমতাবস্থায় জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষিতে ঋণ সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে বিশ্বব্যাংক।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং সেচভিত্তিক কৃষি ও মৎস্য চাষের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্য সুরক্ষা উন্নয়নে ১২ কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রকল্পটির মূল্য ধারায় ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ১ লাখ ৭০ হাজার কৃষক এই প্রকল্পের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির সুযোগ পাবেন, যার মধ্যে অর্ধেকই হবেন নারী।
সম্প্রতি ঢাকার ইআরডি কার্যালয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ফাতিম ইয়াসমিন এবং বিশ্বব্যাংকের পক্ষে বাংলাদেশে সংস্থার ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রিডিরেক্টর দানদান চেন চুক্তিতে সই করেন। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেমবন বলেছেন, বাংলাদেশে ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
প্রকল্পটির নাম-‘ক্লাইমেট-স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট’ বা ‘জলবায়ু সহনশীল কৃষি ও পানি ব্যবস্থাপনা। এই প্রকল্প বন্যা ব্যবস্থাপনা, পানি নিষ্কাশন ও সেচের অবকাঠামো আধুনিকীকরণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ভূমিকা রাখবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীলতা সৃষ্টি, উন্নত সেচ, বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে পানি নিষ্কাশন পরিষেবায় সহায়তা করা হবে। এতে বন্যাজনিত ফসলের ক্ষতি ৬০ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তাছাড়া এই প্রকল্পে কিছু মানুষকে পুনর্বাসন করা হবে। সে লক্ষ্যে দরিদ্র ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বন্যা ব্যবস্থাপনা, সেচ ও পানিনিষ্কাশন উপ-প্রকল্প চিহ্নিত করা করেছে। এর মাধ্যমে এক লাখ কৃষককে জলবায়ু সহনশীল কৃষিপ্রযুক্তি, ফসলের বৈচিত্র্যকরণ ও ফসল তোলা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রকল্পটি দেশীয় প্রজাতি সংরক্ষণ এবং রোগনিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে সহায়তা করবে।
বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতের কাজ করবে প্রকল্পটি। এর মাধ্যমে সমন্বিত ধান ও মাছ চাষসহ উপকূলীয় জলজ চাষকেও সহায়তা করবে, কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করবে এবং স্থানীয় বাজার উন্নয়নে কাজ করবে। এতে মৎস্য উৎপাদন প্রায় ৩৭ শতাংশ, সবজি ১০ শতাংশ ও চাল উৎপাদন সাড়ে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৮২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ এক হাজার ২০ কোটি টাকা। বাকি ১৬২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা সরকারি নিজস্ব তহবিল থেকে মেটানো হবে।
চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তর। পুরো ঋণের ওপর ০ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ (রেয়াতকাল) ৩৫ বৎসরে ঋণটি পরিশোধযোগ্য।
কৃষিখাত খাদ্য সুরক্ষা ছাড়াও জিডিপিতে প্রায় ১২ শতাংশ অবদান রাখছে। তাছাড়া দেশের ৪৪ শতাংশ কর্মশক্তি নিয়োগ করেছে এ খাতে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জোগান দিয়ে থাকে কৃষি৷ অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঝড়, খরা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, উচ্চ তাপমাত্রা, ফ্লাশ বন্যা প্রভৃতির তীব্রতা ত্বরান্বিত হচ্ছে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ প্রায় ২০টি খরা পরিস্থিতির সম্মখিন হয়েছে। ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে খরা শুধু বর্ষার ফসলের উৎপাদনকে প্রভাবিত করেছিল। নব্বইয়ের দশকে ৩৫ লাখ টন ধানের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল।
ধারণা করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শস্যের গুণাগুণ ও উৎপাদনের পরিমাণে পরিবর্তন আসবে৷ বর্তমান চাষ এলাকায় উৎপাদন হ্রাস পাবে৷ পানির স্বল্পতা ঘটবে, হ্রাস পাবে মাটির উর্বরতা৷ ফসলে নতুন নতুন রোগ-বালাই দেখা দিতে পারে৷ ফলে কৃষিতে কীটনাশক ও সারের প্রয়োগ বাড়বে৷ সেচের ব্যাপকতা, ভূমিক্ষয়, মৎস্য বৈচিত্র্য কমে যাওয়া, রাসয়ানিকের ব্যবহার পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে৷ দারিদ্র বাড়বে এবং সমাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে৷ ২১ শতকে সার্বিকভাবে কৃষির উৎপাদন শতকরা ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে৷ ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ধান ও গমের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে জলবায়ু চাপ সহনশীল প্রযুক্তি (বীজ, সার, সেচ ও কৃষি-সংক্রান্ত অনুশীলন) এবং তাদের সম্প্রসারণ গবেষণা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিভিন্ পদক্ষে নিচ্ছে সরকার। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, জ্ঞান পরিচালনা, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও স্থানান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাবগুলো চিহ্নত করতে কাজ করছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থাও । জলবায়ু বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায়ের জন্য নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নিবিড় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষিকে টেকসই অবস্থানে টিকিয়ে রাখতে সহনশীল জাত উন্নয়নে জোর দিচ্ছে সররকার। সেইসঙ্গে কৃষকের হাতের নাগালে যেন সব কৃষি উপকরণ ও সর্বশেষ কৃষিপ্রযুক্তি সহজলভ্য হয়, সেদিকে নজর দিয়ে ননতুন নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সরকার কৃষিক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়েছে। অন্যথায় সামগ্রিক জনজীবনে এটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। চলমান রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার টালমাতাল অবস্থা শঙ্কিত করছে অনেক দেশের নীতিনির্ধারকদের।
আনন্দবাজার/শহক