ঢাকা | শনিবার
২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিক্ষায় গবেষণা সংকট

শিক্ষায় গবেষণা সংকট

বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি আর সাফল্যের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। প্রযুক্তির বহুমুখীধারার সমন্বিত এই রূপ বা ফিউশন টেকনোলজি মানবসভ্যতাকে অভূতপূর্ব এক জগতের দিকে ধেয়ে নিয়ে চলছে। যার সূচনা ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), স্মার্টফোন, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্ট (এআই), রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো যুগ বদলে দেয়া আধুনিক সব তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে। প্রযুক্তির বৈপ্লবিক এই পরিবর্তনের ধারায় বিশ্বের যেকোনো দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনার ধরন, ধারণা ও পদ্ধতিতেও বদল ঘটছে। বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসছে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে। পাল্টে যাচ্ছে জাতীয় থেকে শুরু করে বৈশ্বিক রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি। ইতোমধ্যে গ্লোবাল ভিলেজের প্রতিটি দেশের প্রত্যেকটি খাতের উৎপাদন, সেবা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অভাবনীয় সব পরিবর্তন ঘটছে।

এছাড়া প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছে সেবার চাহিদা ও ধরন। এজন্য সনাতনী পদ্ধতির বদলে তৈরি হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার সার্বিক কাঠামো। যেখানে সংবেদনশীল প্রযুক্তির কৌশল কিংবা ডিভাইস সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞানের পাশাপাশি তাত্ত্বিক দক্ষতা অর্জনেও বাধ্য হতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মী ও কর্তাকে। যন্ত্রকে নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে পারঙ্গম করে তুলতে হচ্ছে নিজেদের। সভ্যতায় প্রযুক্তির এই বিস্ফোরণের মধ্যে শিক্ষাখাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৌড় কেমন হবে বা হচ্ছে তার একটা চিত্র দেখা যায় মার্কিন দূরদর্শী প্রকৌশলী ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা স্যার বাকমিন্সটার ফুলারের ‘নলেজ ডাবলিং কার্ভ’ তত্ত্বে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোনো দেশের শিক্ষাক্রম বা পাঠসূচি কতটা পরিবর্তন করতে হচ্ছে বা হতে পারে তা ফুলারের তত্ত্ব কিছুটা ইঙ্গিত দেয়। যদিও আজ থেকে ৪০ বছর আগে ১৯৮১ সালে ফুলার তার প্রকাশিত ‘ক্রিটিকেল পাথ’ বইয়ে তত্ত্বটি প্রথশ প্রকাশ করেন। আজও তার তত্ত্বের ওপর নির্ভর করেই আগামীর জ্ঞানভিত্তিক পৃথিবীর চিত্র আঁকা যায়।

ফুলার তার তত্ত্বে বলছেন, ১৯০০ সাল অবধি মানবসভ্যতার জ্ঞান বা হিউম্যান নলেজ প্রতি একশ বছরে দ্বিগুণ হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তা কমে ২৫ বছরে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বিগত শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রতি ২৫ বছরে মানবসভ্যতার অর্জিত জ্ঞান দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাচ্ছে। যা অনেকটাই চক্রবৃদ্ধি হারে। যদিও একবিংশ শতকে হিউম্যান নলেজ প্রতিমুহূর্তে এতটাই বাড়ছে যে, সেটাকে জ্ঞান বিস্ফোরণের সঙ্গে তুলনা করা চলে। যা পর্যবেক্ষণ কিংবা হিসাব করা যেমন জটিল তেমনি কঠিনতর।

তবে বিশেষজ্ঞরা কিছুটা অনুমান করে বলছেন, মানবসভ্যতার সামগ্রিক জ্ঞান এখন গড়ে প্রতি ১৩ মাসে চক্রবৃদ্ধি হারে দ্বিগুণ হচ্ছে। অন্যদিকে, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিন বা আইবিএম তাদের গবেষণা থেকে বলছে, বিভিন্ন ডিভাইস বা ব্যবহার্য জিনিসের সঙ্গে ইন্টারনেটের সংযোগ স্থাপনের প্রযুক্তি ইন্টারনেট অফ থিংস বা আইওটি এবং যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ বা এআই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে, প্রতি ১২ ঘণ্টাতেই মানবসভ্যতার জ্ঞান দ্বিগুণ হতে থাকবে।

অথচ অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, ছাপাখানা আবিষ্কারের পর তার অবদান ৫০ মিলিয়ন বা ৫ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছতে সময় লেগেছিল প্রায় একশ বছর। একইভাবে রেডিও নিয়েছিল ৩৮ বছর আর টেলিভিশন মানুষের কাছে পৌঁছাতে নিয়েছিল ১৩ বছর। অথচ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বা ইন্টারনেট মাত্র এক বছরের মধ্যেই ৫ কোটি মানু্ষের কাছে পৌঁছে যায়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিস্তৃতির এই গতি-প্রকৃতি নিয়ে আগে থেকেই কিছু বলার সাধ্য কারো থাকছে না।

এখন ফুলারের তত্ত্ব অনুয়ায়ী বৈশ্বিক জ্ঞান বিস্ফোরণের সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করাতে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষায় বা বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে সরকারকে কতটা মনোযোগ দিতে হবে আর কতটা বরাদ্দ রাখতে হবে তা আর ব্যাখ্যার দরকার হয় না। তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে নাজুক, শুধু ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাই বাড়াচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক যে দক্ষ জনবল প্রয়োজন তা সরবরাহ করতে পারছে না আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সেসব তরুণ বের হয়ে আসছেন তারা শুধু বেকারত্বই বাড়িয়ে চলছেন, দক্ষ জনবলের অভাব পূরণ করতে পারছেন না।

এমন দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় দক্ষতা প্রতিযোগিতা’ বিষয়ক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে। যেখানে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেছেন, দেশের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে আগামীতে এক কোটি দক্ষ লোকের প্রয়োজন পড়বে। বিভিন্ন কারখানায় দরকার হবে ১১ লাখ দক্ষকর্মী। শুধু পোশাক খাতে ৫ থেকে ৭ লাখ বিদেশি জনবল কাজ করছেন। ফলে প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। দক্ষ জনবল তৈরির মাধ্যমে বিদেশি দক্ষ জনশক্তিনির্ভরতা কমাতে হবে।

একইরকম কথা বলেছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। গত ৩০ জানুয়ারি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ও রূপকল্প ২০৪১ অর্জনবিষয়ক এক বৈঠকে তিনি বলেন, এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি সংস্থাগুলোতে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নেই। সরকার ঘোষিত বিভিন্ন অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কর্মসংস্থান তৈরিতে শিল্পায়নের নানা কার্যক্রম হাতে নিচ্ছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। এ ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির অভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবস্থাপনার নানা পদে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের অভাব না থাকলেও শিল্পের প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব রয়েছে।

মূলত, এখানে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতার কথাই বলা হয়েছে। আমরা গ্রাজুয়েট তৈরি করছি ঠিকই তবে তারা প্রযুক্তি কিংবা প্রকৌশলে দক্ষ নন। অথচ সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে হাঁটছে, অর্থনীতি বড় হচ্ছে, কর্মসংস্থান বাড়ছে। রাজনৈতিক এসব বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। দক্ষ জনবল তৈরির জন্য শিক্ষায় যে পরিকল্পনা আর বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ বাস্তবে দেখা যায় না। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষা কিংবা বিজ্ঞান প্রযুক্তিখাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। শিক্ষাবিদরা বিভিন্ন সেমিনারে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠিকভাবে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানালেও ফলাফল শূন্যই থেকে যাচ্ছে। অবশ্য তার ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের তলানিতে অবস্থানের মধ্য দিয়ে।

বিগত অর্ধযুগ ধরে নলেজ ইনডেক্স বা বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে আমরা অনবরত পিছিয়ে থাকছি। বলা যায় আমাদের অবস্থান একেবারে তলানিতে থেকে যাচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশের ওপরে থাকছে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভূটান, ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশগুলো। আবার বিজ্ঞান কিংবা গবেষণাখাতে বাংলাদেশ যে কতটা নাজুক অবস্থানে তা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০২০ সালের তথ্য নিয়ে করা প্রতিবেদনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে দেড়শ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আটটি পাবলিক ও ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাখাতে এক টাকাও খরচ করা হয়নি।

নামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বলা হলেও বাস্তবে অনেক প্রতিষ্ঠানে গবেষণায় কোনো সময় বা অর্থ অপচয় করাই হয় না। প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় যে এক কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করা হলেও প্রকাশনা ছিল মাত্র একটি। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুটি করে প্রকাশনা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় তিন লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয় করলেও প্রকাশনা মাত্র একটি। মূলত, পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরাল ডিগ্রিতে খুবই কম অর্থ ব্যয় করা হয়। অথচ এসব ডিগ্রির জন্য অর্থের পরিমাণ বাড়ালে গবেষণা যেমন বাড়বে তেমনি উচ্চশিক্ষাও সমৃদ্ধ হবে।

বিশ্বজুড়ে শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬-৮ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলা হয়। অথচ বাংলাদেশে সেখানে বাজেটের ১০-১২ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দেয়াই হয় না। এক্ষেত্রে বরাদ্দ জিডিপির ২-৩ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। অথচ তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিক্ষাখাতে সবচেয়ে বেশি ২২ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। এরপর বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞান প্রযুক্তির গুরুত্ব যত বেড়েছে শিক্ষায় ততই কমেছে বরাদ্দ। সারা বিশ্বে শিক্ষায় বাজেট বাড়তেই থাকে, আমাদের দেশে দিন দিন কমতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাবিশ্বে শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয় সেটাকে বিনিয়োগ ভাবা হয়, অথচ আমার ভাবি ব্যয়। সনাতনি এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে হাঁটতে গেলে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিক্ষেত্রে বিশ্বমানের দক্ষতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী তৈরি করতে হবে। আর সেটা হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রকৃতপক্ষেই বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন কিংবা প্রযুক্তিতে পারঙ্গম হতে গেলে সবার আগে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে হবে। এজন্য সমাজকে যেমন তৈরি হতে হবে তেমনি অগ্রসরধারার শিক্ষাক্রম প্রণয়নের মাধ্যমেও এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়িয়ে দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে আমরা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে প্রণীত হওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষানীতিকে পথপ্রদর্শক হিসেবে নিতে পারি। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞানকে হাতে কলমে কাজের বিষয় হিসেবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে একধারার শিক্ষা ব্যবস্থাতেও।

দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের মূলমন্ত্র ছিল, ‘শিক্ষা হবে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও নতুন সমাজ গঠনের অস্ত্র’। সেখানে শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সুপারিশে বলা হয়েছিল, জাতীয় জীবনে শিক্ষককে যথাযথ স্বীকৃতি না দিলে কোনো শিক্ষা সংস্কারই সফল হবে না। তবে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতার কারণে কুদরাত-এ খুদা শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সাল অবধি সময় বেঁধে দেয়া হলেও এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং ২০২০ সালে নতুন করে শিক্ষানীতি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সর্বশেষ শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে মানবতার বিকাশ, জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান নাগরিক গড়ে তোলার বিষয়। সেই সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলার কথাও বলা হয়েছে। তবে প্রথমটির মতোই শেষ শিক্ষানীতিও আটকে আছে নানা জটিলতায়।

শিক্ষাবিদ ও পদার্থবিদ ড. জাফর ইকবাল তার এক লেখায় বলেছেন, শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে যে সব কমিটি গঠন হয় তাতে যেসব শিক্ষাবিদ থাকেন তার মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম থাকেন। যে কারণে বিজ্ঞান শিক্ষা কম গুরুত্ব পায়। অথচ বঙ্গবন্ধু কিন্তু শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব কোনো শিক্ষাবিদকে না দিয়ে একজন বিজ্ঞানীকে দিয়েছিলেন। কুদরাত-এ খুদা ৩৬টি অধ্যায়ের ৪৩০ পৃষ্ঠার শিক্ষানীতি প্রতিবেদন তৈরির জন্য ৯০টি প্রশ্ন দশ হাজার মানুষের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এরকম দৃষ্টান্ত আর দেখা যায় না।

শুধু বিজ্ঞান শিক্ষাই নয়, মূলত আমাদের শিক্ষায় সঠিক, সময় উপযোগী কোনো পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ দেখা যায় না। সব কিছুই চলে অনুকরণে। কোন দেশের শিক্ষা কমিশন কেমন, তারা কীভাবে শিক্ষানীতি করছে, কীভাবে বাস্তবায়ন করছে সেটা নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় শিক্ষানীতি প্রণয়নের ব্যাপারে ততটা আলোচনা হয় না। যে কারণে শিক্ষায় যেমন বাজেট কম, তেমনি বিজ্ঞান শিক্ষায় অনরবত পিছিয়ে পড়ছে দেশ।

মূলত, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে বিজ্ঞান শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নতুন প্রজন্মকে বিশ্বের বাজারে দক্ষ তথা সক্ষম মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করতে শিক্ষাখাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কিছু সুপারিশ তুলে ধরতে পারি-

১. শুধু ঘোষণাতেই নয়, বাস্তবেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে বাজেটে শিক্ষাকে চতুর্থ নয়, এক নম্বর অবস্থানে আনতে হবে।

২. শিক্ষাবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। শিক্ষাখাতের বরাদ্দকে ব্যয় হিসেবে নয়, বরং বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে।

৩. গবেষণা বা বিজ্ঞানাগারের পরিধি বাড়াতে হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। এ জন্য বাজেটে বেশি বরাদ্দ রাখতে হবে।

৪. ঝকমকে অবকাঠামোর চেয়েও বেশি জরুরি দক্ষ, যোগ্য, মেধাবী শিক্ষক। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনায় অদক্ষদের বদলে মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। যেন বেশি সুবিধার জন্য তারা অন্যদিকে দৃষ্টি না ফেরান।

৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ জ্ঞানচর্চার উপযোগী করতে হবে। এজন্য অবকাঠামো থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্যাম্পাসে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, বিদেশি বিজ্ঞান জার্নাল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে শুধু রাজনীতিক বা বিপ্লবীই নয়, ভারতবর্ষের বিজ্ঞান জাগরণের অগ্রদূতসহ বিশ্ববিজ্ঞানের অগ্রনায়কদের অবদান ও জীবনপাঠ রাখতে হবে।

৬. সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নিতে হবে রাজনীতিকদের। জনসাধারণের কাছে তারা শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে প্রস্তুত করতে সহযোগিতা করবেন। শিক্ষকদের সময় ‍উপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন।

৭. শিক্ষাবিষয়ক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটাতে হবে। শিক্ষার মূল্যায়ন করতে হবে। জাতিগতভাবে শেখার এবং জ্ঞানার্জনকে উৎসাহ দেয়ার মতো সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগ নিতে হবে।

৮. সবার আগে শিক্ষাখাতকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার সম্মিলিত অঙ্গীকার করতে হবে। মেধা আর মননে সমৃদ্ধ করতে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে শিক্ষাকে।

৯. শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যেসব কমিটি গঠন করা হয়, সেখানে বিজ্ঞান শিক্ষক তথা খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের রাখতে হবে। তাদের পরামর্শ অতি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। বাজেট প্রণয়নে এসব বিষয় ভাবনায় রাখতে হবে।

১০. শিক্ষা সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জনমত যাচাই করতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ এমনকি শিক্ষার্থীদের মতামতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন