উত্তরবঙ্গ তথা রংপুর বিভাগের অন্যতম বাণিজ্যিক শহর নীলফামারীর সৈয়দপুর। প্রতিবছরের মত এবারও জমে উঠেছে সৈয়দপুরে ফলের পাইকারী বাজারে কুলের বেচাকেনা। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী পাইকার ও বাজার নিয়ন্ত্রণকারী স্থানীয় ফল আড়তদারদের কারসাজিতে ঠকছে বাগান মালিক বা ফলচাষী ও সাধারণ ক্রেতা।
প্রায় প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের আড়তগুলোতে আসছে বিভিন্ন জাতের কুল। বিশেষ করে বাউ আর আপেল কুলে ভরা চারদিক। তবে এবার বলসুন্দরী কুলই বেশি দৃষ্টি কেড়েছে ক্রেতার। ফলে বাজারও ধরতে পেরেছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় ফল আড়তদার তথা পাইকারী ফল ব্যবসায়ীরা।
ফেরি করে বিক্রিকারী বা পাড়া মহল্লার ছোট দোকানী খুচরা ক্রেতাদের এই বাজার থেকে কুল কিনতে দেয়া হয় না। বরং কুল বাগান মালিক বা চাষীদের আড়তদাররা ইচ্ছে মাফিক দামে বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। একইভাবে খুচরা ক্রেতাদেরও বাধ্য করা হচ্ছে আড়তদারদের কাছ থেকে ক্রয়ে। এতে সহযোগিতা করছে পৌরসভার টোল আদায়ে নিয়োজিত ব্যক্তিরাসহ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক মহল।
জানা যায়, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর ও পার্বতীপুরসহ রংপুর বিভাগের অন্যতম ব্যবসার কেন্দ্রস্থল হচ্ছে সৈয়দপুর। আর এ কারণেই ওইসব এলাকার কুল চাষি বা ব্যবসায়ীরা সঠিক দাম পেতে এবং অল্প সময়ে বিক্রির জন্য ট্রাক, পিকআপ, নছিমন, রিকশা-ভ্যান ও ট্রেনে কুল নিয়ে আসছেন সৈয়দপুরে।
এমনকি দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দর, রংপুরের তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, বগুড়ার সান্তাহার, পাবনার ঈশ্বরদী, নাটোরসহ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকেও সৈয়দপুরের পাইকারী বাজারে কুল আসছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চলছে কুলের কেনাবেচা। আশপাশের চাষিরা কুল আনছেন ভ্যান, পিকআপে আর বাইরের চাষিরা বাহন হিসেবে ব্যবহার করছেন ট্রেন। প্রতিদিন প্রচুর কেনাবেচা হয় সৈয়দপুরের ফলের আড়তসহ মৌসুমী বাজারগুলোতে।
শহরের ১নং রেলঘুমটির পাশেই প্রায় অর্ধ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা পাইকারী বাজারে গত বছরের তুলনায় এ বছর তুলনামূলক বেশি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের। এছাড়া শহরের গোলাহাট, রেল কারখানা গেট বাজার, চৌমুহনী, নিচুকলোনি, আদানী মোড়, টার্মিনাল ও বিমানবন্দর বাজার ছাড়াও গ্রামের হাটগুলোতে বসছে খুচরা কুলের বাজার।
কুলের প্রকার ভেদে নির্ধারণ করা হচ্ছে দাম। ভালো জাতের কুল কৃষক বিক্রি করছেন ৫০ থেকে ১০০ টাকায় কেজি। পাইকাররা সেই কার্টুন বা ঝুড়ি বোঝাই কুল বিক্রি করছেন গড়ে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ১৫০ টাকায়।
বাউ কুল মিষ্টি কম হলেও আকারে বড় আর আপেল কুল সাইজে ছোট কিন্তু মিষ্টি বেশি। খুচরা পাইকাররা সেই বাউকুল ৮০ টাকা, বলসুন্দরী ১০০ আর আপেল কুল ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। ফলে কুলের উৎপাদনকারী চাষি দাম পাচ্ছেন সামান্য। মূল লাভটা ঘরে তুলছেন মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা।
নাদিম ও হাসান নামের দুই আড়তদার জানান, গতবারের তুলনায় চলতি মৌসুমে ৩ গুণ বেশি কুল তাদের আড়তে এসেছে। কুলের আমদানি যেমন বেড়েছে তেমনি ক্রেতারও কমতি নেই। তবে এবার সিজনের সময় অনেক কম পেয়েছি আমরা। কারণ প্রায় একই সময়ে সব ধরণের কুল একসাথে পেকেছে।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দিলালপুরের বাগান মালিক আমজাদ ও জব্বার জানান, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের ভাল ব্যবস্থা থাকলেও তাদের কুল বিক্রির জন্য সৈয়দপুরের বাজারই পছন্দ। তবে গত কয়েকদিন যাবত শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে দূরের ক্রেতারা না আসায় ও সীমিত সংখ্যক পরিবহণ চলাচল করায় কম দামে কুল বিক্রি করতে হচ্ছে।
আড়তে আসা রংপুরের আল মামুন জানান, সৈয়দপুরের বাজার ভালো, তাই প্রতিদিনই এখানে নিজের বাগানের কুল নিয়ে আসি। কুলের আকার হিসেবে প্রতিমণ এক হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। তবে এখানে যার দোকানের সামনে অস্থায়ী বাজার, তারা শতকরা ১০ টাকা করে নিয়ে নেন। ১৪ হাজার টাকার কুল বিক্রি করেছি, যার মধ্যে ১৪০০ টাকা দিতে হয়েছে। তাছাড়া আসা যাওয়ায় পৌরসভার টোল তো আছেই। এভাবে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হওয়ায় চাষী বা বাগান মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে সৈয়দপুর শহরের খুচরা বাজারগুলোও অন্যান্য নিয়মিত ফলের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের কুল-বড়ই দিয়ে ভরে গেছে। সব দোকানেই নানা জাতের কুলের ব্যাপক সমারোহ। সেইসাথে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা পাড়া মহল্লাসহ রাস্তায় ফেরী করে বাউ ও আপেল কুল বিক্রি করছেন। এতে ক্রেতারা হাতের নাগালেই মৌসুমি এই ফল পেয়ে রসাস্বাদন করছেন।
শহরের বাঁশবাড়ী এলাকার শাহ জালাল জানান, আপেল, কমলা, আঙ্গুর, বেদানা সচরাচরই খাই। কিন্তু এরসাথে মৌসুম অনুযায়ী আম, আমড়া, বেল, কামরাঙা, জামরুল, তরমুজ, বাঙ্গী, ড্রাগন, আনারস, জাম, কদবেল, স্টবেরীও খাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু বেশি খাওয়া হয় কলা, পেয়ারা আর কুল বা বড়ই। এখন কুলের সিজন তাই এটিই ফলের তালিকায়।
তিনি বলেন, কুল কিনে বেশ স্বাচ্ছন্দ বোধ হয়। কারণ এটি ভ্যারাইটিজ জাত ও সাইজের হয়। দামও থাকে নাগালের মধ্যে। ফলে শুরু থেকে মৌসুমের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতের কুল খাওয়া চলে। তবে বাউ, থাই ও আপেল কুলটার স্বাদ বেশি মজার হওয়ায় এগুলোই বেশি কিনি। এবার অবশ্য বলসুন্দরী কুলই আকর্ষণ করেছে।
গোলাহাট এলাকার সাইকেল পার্টস ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, এবার বাজারে ব্যাপকহারে কুল উঠেছে। কিন্তু সেই হারে দাম কমেনি। অথচ পাইকারী বাজার থেকে খুচরা বাজারে দামের বেশ ফারাক। এতে মনে হয় কৃষক তথা ফল চাষীরা কম দামে বিক্রি করলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারনে ক্রেতা বা ভোক্তাদের বেশি দামে কুল খেতে হচ্ছে। এজন্য তিনি প্রশাসনকে বাজার মনিটরিং করার আহ্বান জানান।