পানিতে ট্রলার ভাসাবেন সে টাকাও ছিল না। অবশেষে স্ত্রীর গহণা স্থানীয় মহজনদের কাছে বন্ধক রেখে টাকা সংগ্রহ করেন লক্ষ্মীপুরের রামগতির জেলে আবুল খায়ের। এরপরে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার ও মাছ সংরক্ষণ করার জন্য পর্যাপ্ত বরফ নিয়ে সাগরে যাত্রা শুরু করে খায়েরের মালিকানাধীন ‘এফবি রিভারমেট’ নামের ফিশিং বোট। সাগরে গিয়ে একবার জাল টেনে ট্রলার বোঝাই করে মাছ নিয়ে পটুয়াখালীর মৎস্য বন্দর মহিপুরে ফিরে ট্রলারটি। সম্পূর্ণ মাছ উঠানো হয় ওই বন্দরের ‘মিঠুন ফিশ’ নামের মাছের আড়তে। পরিমাপ করে জানা গেল ১৭০ মন মাছ পেয়েছেন জেলে আবুল খায়ের। যার বাজার মূল্য পেয়েছে ৫৪ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা। এই মহজনই চলতি সিজনে ওই বন্দরে সবচেয়ে বেশি মাছ পেয়েছেন।
শুধু আবুল খায়ের নন, এর আগে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের শেষ বয়া সংলগ্ন সাগরে জাল ফেলে একটানেই ৪০ লাখ টাকার মাছ পেয়েছেন মিজান মাঝি। এভাবেই একেরপর এক কাঙ্খিত ইলিশের দেখা পাচ্ছে সাগরের জেলেরা। অপরদিকে নদীতে হাহাকার; ইলিশ শূন্য প্রায় নদী। নদীর জেলেরা আশানুরূপ মাছ না পেয়ে ঋণগ্রস্থ হচ্ছে। পরিবার পরিজন কষ্টে দিন পাড় করছে। আর মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ‘সাগর মোহনা ও নদীতে অসংখ্য ডুবোচর জেগে উঠায় ইলিশ মাছ প্রবেশ পথ হারিয়ে ফেলেছে।’ জেলেদের মতো একই অবস্থায় রয়েছে নদীপাড়ের মৎস্য ব্যবসায়ীরা। নদীতে পর্যাপ্ত মাছ ধরা না পড়ায় মোকামের ঋণের টাকা পরিশোধ নিয়েও রয়েছে তাদের দুশ্চিন্তা।
জানা গেছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর। এই তিন মাস নদ-নদী এবং সাগরে ইলিশ মাছ ধরার মৌসুম। টানা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ৭-১০ দিনের রসদ নিয়ে ২৩ জুলাই সাগরে মাছ শিকারে যাত্রা করে উপকূলের জেলেরা। কিন্তু মৌসুমের প্রথম দিকে আশানুরূপ ইলিশ না পাওয়ায় জেলেরা লোকসানের মুখে পড়ে। তার ওপরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সাগরে ইলিশের দেখা মিলেছে। জেলের জালে ধরা পরছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। বড় সাইজের এসব ইলিশ বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে লাভবান হয়েছেন অনেকে। তবে পায়রা বন্দর এলাকার নদীগুলো এখন ইলিশ শূন্য প্রায়। এখানকার জেলেরা তেলের খরচ পরিমাণ মাছ আহরণ করাই দুষকর হচ্ছে। ফলে দিনদিন ঋণের বোঝা বেড়েই চলছে। জেলেরা অভিমান নিয়ে বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে পেশা বদলে বাধ্য হবেন তারা। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন এবার মৌসুমের শুরু থেকে ইলিশ সংকট ছিল প্রকট। তবে মৌসুমের শেষাংশে হলেও নদীতে ইলিশের দেখা মিলবে। এতে করে প্রাণ ফিরে পাবে জেলে পল্লী।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, জেলায় নিবন্ধিত ৭৩ হাজার ৩৭১ জন জেলে রয়েছে। যারা সরকারি সকল সুবিধাভোগী।
কোড়ালিয়া মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জহির হাওলাদার জানান, মৌসুমের শুরুতে নদী ও সাগরে কাঙ্খিত ইলিশের দেখা মেলেনি। তবে এখন সাগরে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। নদীতে ইলিশ শূন্য প্রায়। মাছ না থাকায় জেলেরা হয়েছে ঋণগ্রস্ত। আর ব্যবসায়ীক ক্ষতিরমুখে পড়েছে মৎস্যঘাট সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। আশা করছি শীঘ্রই নদীতে ইলিশ পাওয়া যাবে। যার ফলে মৎস্যঘাটে কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরবে।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, একোয়াকালচার ও মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এখন ইলিশের মৌসুম। সাগরের জেলেরা মাছ পাচ্ছে। আমরাও আশা করছি, নদীর অন্যান্য জেলেদের জালেও শিগগিরই কাক্সিক্ষত ইলিশ ধরা পড়বে। হাসি ফুটবে তাদের মুখেও।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের ডিমের পরিপক্কতা আসে নাই। ডিমে পরিপক্কতা না আসলে ইলিশ কখনোই সাগর থেকে নদীতে আসবে না। ইলিশ নদীতে আসবেই প্রজননের জন্য। অথাৎ প্রজনন প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করার জন্য ইলিশের সক্ষমতা এখনও হয়নি। যার কারণে সাগর থেকে নদীর দিকে ইলিশ আসে নাই। শীঘ্রই ডিমে পরিপক্কতা আসলে দ্রæত নদীতে আসা শুরু করবে। এখন সাগরে ইলিশ পাওয়ার কারণ সবে মাত্র গভীরতম স্থর থেকে উপরস্থরে ইলিশ কেবল আসা শুরু করছে।’