পুঁজিবাজারের অস্বাভাবিক পতন ঠেকানো সহ সাধারন বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষায় শেয়ার দর কমার ক্ষেত্রে ফ্লোর প্রাইস দিতে বাধ্য হয়েছি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। একই সঙ্গে বলেন, অবশেষে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের হিসাব বাজার মূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে হচ্ছে। গতকাল রবিবার ‘সিএমজেএফ টক উইথ অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। এসময় সিএমজেএফের সভাপতি জিয়াউর রহমান ও সাধারন সম্পাদক আবু আলীসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
নিরুপায় হয়ে ফ্লোর প্রাইস দিয়েছি জানিয়ে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, আমরা শেয়ার দর কমার ক্ষেত্রে ২ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার এবং ফ্লোর প্রাইস দিতে চাইনি। কিন্তু নিরুপায় হয়ে দিয়েছি। সাধারন বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষা করতে এটি দিতে বাধ্য দেয়া হয়েছে। কারন আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর অনেক সংখ্যা বেশি। ফলে তাদের পুঁজি রক্ষায় এটা করা হয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশে সার্কিট ব্রেকার এবং ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয় না। কারন সেখানে শিক্ষিত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি।
শুধু ইক্যুইটি (শেয়ার ও ইউনিট) দিয়ে জিডিপির তুলনায় পুঁজিবাজারের আকার ধরে রাখা এবং ২০ শতাংশের বেশি করা সম্ভব না জানিয়ে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, যেসব দেশে জিডিপির তুলনায় পুঁজিবাজারের আকার বড়, সেসব দেশ বন্ড মার্কেট দিয়ে বড় হয়। আমাদের দেশেও বন্ডের লেনদেন শুরু হলে পুঁজিবাজারের আকার বড় হয়ে যাবে। তখন লেনদেনের পরিমাণও বেড়ে যাবে।
অবশেষে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের হিসাব বাজার মূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে হচ্ছে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত বলেন, এখন প্রক্রিয়া শেষে শিগগির বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। ওই সংক্রান্ত বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন, আমি ছিলাম, গভর্নর উপস্থিত ছিলেন। আমরা আলাপ-আলোচনা করেই করেছি। এখন যেটা হচ্ছে, সেটা প্রসিডিউর। আমাদের আলোচনা হয়েছে, হয়ে যাবে। আমরা তিনজনই একমত। এই গভর্নর যখন সচিব ছিলেন, তখন ফাইলটা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। ওনার সুপারিশ নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংকে ফাইল যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপরের লেভেল ঠিক ছিল। কারণ ডেপুটি গভর্নর উপস্থিত ছিলেন মিটিংয়ে। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশ ব্যাংক) যাওয়ার পর জুনিয়র অফিসার কেউ হয়তো নেগেটিভ দিয়ে ফাইলটা এমনভাবে করে ছিলেন, যাতে গভর্নর করতে পারেননি। যাই হোক, নতুন গভর্নর আসার দুদিন পরই আমরা ওনার সঙ্গে দেখা করি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফাইলটি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন জাস্ট এটা প্রসিডিউরে আছে।
ব্যাংকের এক্সপোজারে বন্ড অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, গভর্নর এমডিদের সঙ্গে বৈঠকে বলে দিয়েছেন আমাদের সে বন্ডগুলো সিকিউর সেগুলোর সব এক্সপোজারের বাইরে থাকবে। কিন্তু সেটা যদি অ্যাসেট ব্যাক না হয়, ডিবেঞ্চার টাইপের হয় বা রিক্স টাইপের হয় তাহলে সেটা আর এক্সপোজারের বাইরে রাখা হবে না, ওটা এক্সপোজারের ভেতরে ঢুকে যাবে।
নানান খবরে পুঁজিবাজার পতন জানিয়ে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, বিএসইসি কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বড় বিনিয়োগকারীরা সাপোর্ট দেবেন বলার পরেও পুঁজিবাজারের পতন। কারন ওই সভার পরে বড় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনে সাপোট দিয়েছেন। তবে আমাদের দেশে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে বিক্রির চাপও অনেক বেশি। এতো বেশি বিক্রির চাপ, যে তাদের (ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী) বিক্রির চাপ কুলিয়ে উঠতে পারেনি। পুঁজিবাজার নেতিবাচক।
পুঁজিবাজার প্রতি যাদের জ্ঞান কম, তাদেরকে মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দিয়ে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে পোর্টফোলিও ম্যানেজ করতে হয় না। যা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রফেশনাল লোকজন দিয়ে ম্যানেজ করা হয়। যার ফলে ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়। গত ২ বছরের বিশ্লেষণে প্রায় ৯০ শতাংশ মিউচ্যুয়াল ফান্ড থেকে প্রায় ১২ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে দেখেছি। এ বছরও ভালো লভ্যাংশ দিবে। তাই যারা পুঁজিবাজার সর্ম্পক্যে ভালো বুঝেন না, তারা মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন।
রোড শোর সফলতা প্রসঙ্গে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, বিদেশে থেকে আমরা টাকা আনতে যাইনা। দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারকে ব্র্যান্ডিং করতে যাই। দেশের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে যাই। এখন অনেকেই বাংলাদেশকে জানে না। আবার অনেকেই ভূল যানে। তাই সঠিক ধারনা দিতে আমাদের এই রোড শো করা। রোড শোর করার পর বিভিন্ন দেশ থেকে আমরা অনেক বিনেয়াগ সাড়া পাচ্ছি। বর্তমানে অনেকেই আমাদের যোগাযোগ করছে। তারা আমাদের কাছ থেকে আরো অনেক তথ্য নিচ্ছে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে যোগাযোগও করছেন।
অবন্টিত লভ্যাংশ প্রসঙ্গে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান অবন্টিত লভ্যাংশ জমা দিচ্ছে না ক্যাপিটাল ম্যার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে (সিএমএসএফ)। যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো দেননি, তাদেরকে জরিমানাসহ লভ্যাংশ আগামিতে দিতে হবে। এটা অনেকটা দৈনিক ভিত্তিতে সুদ গণনার ন্যায় হবে। এ লক্ষ্যে গেজেট প্রকাশের জন্য কাজ করা হচ্ছে।
আয়ের থেকে শাস্তি কম বিষয়ে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, আমাদেরকে অনেক পুরাতন অভিযোগ দেখতে হচ্ছে। ১৫ বছর আগেরও। তারপরেও আমরা বিগত ২ বছরে যে পরিমাণ শাস্তি প্রদান করেছি, তা আগের ১০ বছরেও করা হয়নি। এরই মধ্যে আবার করোনায় সবার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার দিকটি বিবেচনা করতে হচ্ছে।
ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবার প্রসঙ্গে শিবলী রুবাইয়াত বলেন, ভালো কোম্পানি আনার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। তবে সবাই চায় ভালো অ্যাকাউন্টস জমা দিয়ে আসতে। এ কারনে অনেকে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। হয়তো জুন ক্লোজিংয়ের হিসাবে কয়েকটি ভালো কোম্পানির আবেদন জমা পড়তে পারে। তবে আমরা যখন ভূয়া অ্যাকাউন্টস বুঝতে পারি, তখন সেসব আইপিও ফাইল বাতিল করে দেই। অনেক ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনতে পাচ্ছি না। এটি অনেকটা কোম্পানির পর্ষদের মানসিক সমস্যা। তারা ভাবছে কোম্পানি যেহেতু ভালো ব্যবসা করছে, সেহেতু বাজারে কেনো যাবো। এছাড়া কোম্পানির মালিকানা অন্যদের হাতে ছাড়তে চায় না। আবার এজিএমে অপমানিত হতে হবে ভেবে আসতে চায় না।
আনন্দবাজার/শহক