পুঁজিবাজারে উন্নয়নসহ বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার জন্য একগুচ্ছ দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। গত শনিবার সিএসই কর্তৃক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বেশকিছু দাবি জানান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম। সিএসইর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছানোর লক্ষ্যে, বেসরকারি বিনিয়োগ ও জিডিপি অনুপাতের কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রয়াসে নতুন অর্থবছরে (২০২২-২০২৩) বাজেটে কর্পোরেট করহার কমানোর প্রস্তাব করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে বেসরকারি বিনিয়োগ ও জিডিপি অনুপাত ২৩ শতাংশ।
উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সরকার এ অনুপাত বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করছে। যা খুবই ইতিবাচক উদ্যোগ। প্রস্তাবিত বাজেট পরবর্তী এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সিএসইর পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো পুনঃবিবেচনার জন্য অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ দাবি জানান আসিফ ইব্রাহিম।
বিগত অর্থবছরে বাজেটে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহ বাজারবান্ধব ছিল। এবছর আমাদের সিএসই থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, বিদ্যমান বিধানসমূহ যেন অপরিবর্তিত থাকে। আমরা আনন্দিত যে, প্রায় সকল বিধান অপরিবর্তিত রাখা হয়। তবে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যদের লেনদেনের ওপর বিদ্যমান উৎস কর দশমিক শূন্য ১৫ শতাংশ নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছিল যা বাজেটে বিবেচিত হয়নি। ব্রোকারেজ হাউজগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পরিচালন খরচ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে ব্রোকারেজ সেবার কমিশন অত্যন্ত কমে আসার কারণে এই কর্তনকৃত অর্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর করদায় হিসেবে অধিক হয়। তাই উৎসে করহার হ্রাসে আমাদের প্রস্তাব পুনঃবিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এছাড়াও ব্রোকারদের বিও অ্যাকাউন্ট মেইনটিনেন্স ফী হতে প্রাপ্ত আয় ১০০ টাকা হতে বিবেচ্য করকে উল্লেখিত দশমিক শূন্য ১৫ শতাংশ উৎসে কর সংযুক্ত হয়েছে বলে বিবেচনা করার জন্য আবেদন করছি।
অর্থনীতির অধিকতর আনুষ্ঠানিকীকরন এবং এক ব্যক্তি কোম্পানির প্রতিষ্ঠা উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রত্যাশিত বাজেটে এক ব্যক্তি কোম্পানির কর হার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের অধিক শেয়ার এর ক্ষেত্রে, প্রাথমিক গনপ্রস্তাবে ( আইপিও ) আগত তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য করহার ২২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়। তবে ১০ শতাংশ বা তার কম শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তরকারী লিস্টেড কোম্পানির কর হার না কমিয়ে পূর্বের হার অর্থাৎ ২২ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের কর হার হ্রাসের এই ঘোষণাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে পুঁজিবাজারে ভাল কোম্পানির তালিকাভুক্তিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের ব্যবধান ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা যেতে পারে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির মধ্যে কর হারের ব্যবধান খুবই কম। তাই ভালো কোম্পানি এই বাজারে আসতে আগ্রহী হয়না। কারণ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে নানা ধরণের কমপ্লাইয়ান্স পরিপালন করতে হয়। এতে কোম্পানিগুলোকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়। ফলে কর হার রেয়াতের প্রকৃত কোন সুবিধা ভোগ করা যায় না।
অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর করহার কমিয়ে তালিকা বহির্ভূত কোম্পানিগুলোর সাথে কর হারের ব্যবধান বাড়ানো হলে কর সুবিধা রেয়াতের জন্য ভালো কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী হবে। এতে একদিকে পুঁজিবাজার সমৃদ্ধ হবে, অন্যদিকে লেনদেন বাড়লে তা থেকে বাড়তি কর আদায় হবে। তাছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা ও জাবাদিহিতা বাড়ে। নানা সংস্থার তদারকিতে থাকতে হয় বিধায় কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ কমে আসে। তাতে সরকারের কর সংগ্রহ নিশ্চিত হয় ।
কৌশলী বিনিয়োগকারী আকর্ষণ করা সহ স্টক এক্সচেঞ্জ এর কারিগরি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য মূলধন পুনঃবিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। বিনিয়োগকারীদের জ্ঞান ও দক্ষতা ও দীর্ঘমেয়াদে একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠনের লক্ষ্যে সিএসই এর আর্থিক সক্ষমতা প্রয়োজন হলেও বর্তমানে এক্সচেঞ্জসমূহের আয় উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া সিএসই বাংলাদেশে প্রথম কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এটি গঠন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কারিগরি সহায়তা, আইন-কানুন প্রণয়ন, প্রশিক্ষন প্রদান ও গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে উপরোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করে, চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ এর জন্য বর্তমানে বিদ্যমান প্রযোজ্য কর্পোরেট করহার যা ৩০ শতাংশ, তা জুন ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত শূন্য হারে নির্ধারণ করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লাভজনক কোম্পানিসমূহের শেয়ার বিক্রির কথা বিভিন্ন সময়ে বলা হলেও ঘোষিত বাজেটে এর কোনো পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থায়নের উৎস হিসেবে শেয়ার অফ লোড করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিসমূহ পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এবং এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো কর ছাড় থাকতে পারে ।
প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের জন্য ১০ শতাংশ কর পরিশোধ করে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা রহিত করা হয়েছে। এই সুবিধা আগামী বছর পর্যন্ত বহাল রাখার জন্য আমরা বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। এতে বাজার যেমন শক্তিশালী হব তেমনি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, পাশাপাশি অর্থ পাচারও কমবে বলে আমরা আশা করছি।
সাধারণত স্বল্পমূলধনী কোম্পানিসমূহ প্রাইভেট হিসেবে নিবন্ধিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট কাঠামো দুর্বল হওয়াতে সরকারের তেমন কোন রাজস্ব আদায় হয় না । বর্তমানে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এসএমই বোর্ড এর মাধ্যমে স্বল্প মূলধনী কোম্পানিসমূহকে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত করছে। আমরা তালিকাভুক্ত এসএমই কোম্পানিসমূহের জন্য প্রথম ৩ বছর শূন্য হারে এবং পরবর্তীতে ১৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছিলাম যা সুবিবেচিত হয়নি।
পুঁজিবাজারে এসএমই বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী তালিকাভুক্ত হলে অধিক সংখ্যক কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড থেকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত হবে এবং একটি মানসম্মত কর্পোরেট কাঠামো এবং রিপোটিং-এ অভ্যস্থ হবে যা থেকে সরকারের প্রত্যক্ষ করের পাশাপাশি পরোক্ষ করও বৃদ্ধি পাবে । তালিকাভুক্ত কোম্পানির লভ্যাংশ বাবদ আয় থেকে কেটে রাখা করকে চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব করছি ।
নিয়ম অনুসারে প্রতিটি কোম্পানিকে তার আয় এর উপর কর দিতে হয় । এরপর নিট মুনাফা নির্ধারিত হয় । এই মুনাফা থেকে কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণা করলে এবং এই লভ্যাংশ বিতরণের সময় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে আগ্রিম কর কেটে দিতে হয় । পরবর্তী সময় আবার লভ্যাংশ গ্রহীতার ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্নের সময় তার উপর প্রযোজ্য হারে কর প্রদান করতে হয় । এইভাবে কর প্রদান দ্বৈত কর নীতির আওতায় পরে। এক্ষেত্রে অগ্রিম করকে চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে ।
তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত নগদ লভ্যাংশ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়কর মুক্ত।এই করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা যেতে পারে। সিএসই মনে করে মুদ্রাস্ফিতির কারনে করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের এই সীমা বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন । মিউচুয়াল ফান্ড বা ইউনিট ফান্ড থেকে প্রাপ্ত নগদ লভ্যাংশ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়কর মুক্ত। এই মিউচুয়াল ফান্ড বা ইউনিট ফান্ড থেকে প্রাপ্ত নগদ লভ্যাংশকে সম্পূর্ণ আয়কর মুক্ত রাখা যেতে পারে। মিউচুয়াল ফান্ড ইন্ডাস্ট্রিকে প্রসারিত হতে উৎসাহিত করার জন্য এই সুবিধা দেয়া যেতে পারে।
আনন্দবাজার/শহক