ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জলবায়ুর থাবা সবজি বাজারে

জলবায়ুর থাবা সবজি বাজারে

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বড় প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বিশেষ করে কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ডে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। অতিবৃষ্টি, অসময় বৃষ্টি, অতি শৈত্যপ্রবাহ বা তাপদাহ মারাত্মকভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আর ধরণ পরিবর্তিত হয়ে এসব বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বৈরী জলবায়ুর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিখাত সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা।

জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম নিদর্শন বৃষ্টিপাতের ধরন গেল প্রায় দুই দশক ধরে পাল্টে গেছে। বর্ষকালের দুই মাস আষাঢ়-শ্রাবণে অস্বাভাবিক বৃষ্টির দেখা মিলছে। আবার শরৎ বা হেমন্তকালে ঘটছে অতিবর্ষণ। যাতে করে মারাত্মক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এর ওপর অতিখরাসহ সেচভিত্তিক মাত্রাতিরিক্ত বোরো চাষের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন ভয়াবহভাবে নিচে নামছে। এতে মৌসুমভিত্তিক সবজি বা কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় সেচ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটছে। বিশেষ করে শাক-সবজি চাষ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত বিঘ্নিত হওয়ায় ঘন ঘন বন্যা ও খরার মুখে পড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন দেশের কৃষিখাতে অবধারিত নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট শস্য বা সবজির বেড়ে ওঠার জন্য পরিমিত মানের জলবায়ুর তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতি উপাদানগুলোর যে প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত দেড় থেকে দুই দশক ধরে জলবায়ুর উপাদানগুলো বৈরী আচরণ করছে।

জলবায়ুর এসব বিরূপ পরিবর্তন কৃষি উৎপাদনসহ বাজার ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অতিবৃষ্টি কিংবা অসময় বৃষ্টি হলেই অস্থির হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে পণ্য বা কাঁচাবাজার। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হোক বা না হোক বাজারে হঠাৎ করেই পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়। অনেক সময় পরিবহন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার ওপর দায় চাপানো হয়। তবে পরিবহন সচলসহ সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরেও শুধু আবহাওয়ার বৈরী আচরণের কারণেই বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারন করেছে।

গত পাঁচ দশকের বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গেল শতকের ষাটের দশকের বর্ষা মৌসুম শুরুর সময় এবং শুরুর আগে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হতো গত অর্ধশতকে তার পরিমাণ কমে গেছে। তবে অন্যদিকে, বিলম্বিত বর্ষা আর বর্ষা মৌসুমের শেষদিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। এমনকি শীত মৌসুমে বর্ষার মতো বৃষ্টিপাত বা টানা বর্ষণ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের অবদানের প্রায় ৫৫ ভাগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি। সেই সঙ্গে দেশের প্রায় ৫৪ ভাগ মানুষ কৃষি পেশায় নিয়োজিত। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বৈরী জলবায়ুর কারণে দেশের কৃষিখাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বরাবরই সতর্ক করে দিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলের চাষাবাদের ওপর প্রভাব পড়ছে।

চলতি শীত মৌসুমে গেল কিছুদিন ধরেই দেশে অস্বাভাবিক বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। মাঘের শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেই হঠাৎ দেখা দিয়েছে প্রবল বৃষ্টি আর দমকা বা ঝড়োহওয়া। কোথাও কোথাও আবার ব্যাপক শিলাবৃষ্টিও হয়। এতে মৌসুমভিত্তিক শস্য বিশেষ করে শীতের শাকসবজির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ঠিকই তবে তার প্রভাব বাজারে পড়তে কোনো কাল বিলম্ব করেনি। বৃষ্টি শুরু হলেই দাম বেড়ে যায় সবজিসহ সব নিত্যপণ্যের। অস্থির হয়ে ওঠে বাজার।

কৃষিপণ্য বিক্রেতারা বলছেন, বৃষ্টি হলেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কারণ, তখন বিক্রেতারা আশঙ্কা করেন, তারা বিক্রির জন্য কিছুদিন পণ্য পাবেন না। অর্থাৎ পাইকাররা দাম বাড়িয়ে দেবে। স্বাভাবিক দামে পণ্য মিলবে না। বিধায় তারা স্টকে থাকা পণ্য সহজে ছাড়তে চান না। আর এজন্যই তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেন। অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, আবহাওয়া বৈরী হলেই দাম বেড়ে যায় সব ধরনের পণ্যের। যার কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। বিক্রেতারা বলেন, আবহাওয়া খারাপ। তাই পণ্য পরিবহন বিঘ্নিত। তাই দাম চড়া। গত কয়েক দশক ধরেই এমন সমীকারণে ঘুরপাক খাচ্ছে পণ্যবাজার।

গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (আইএফএডি) কান্ট্রি ডিরেক্টর আর্নড হ্যামলার্সের সঙ্গে বৈঠককালে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক শীতের ভরা মৌসুমে সবজির দাম বেশি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নিজেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, পর্যাপ্ত উৎপাদনের পরও শীতের এই ভরা মৌসুমে সবজির দাম এত বেশি কেন? কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ‘এই সময় সবজির দাম কেন এত, একটা লাউ, একটা ফুলকপির দাম এত বেশি কেন? উৎপাদন তো কম হয়নি। বাজারে সবজির এই অস্বাভাবিক দামের কারণ খুঁজতে চেষ্টা করেছেন দৈনিক আনন্দবাজারের বিভাগীয় প্রতিনিধিরা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন