উচ্চশিক্ষিত বেকার তরুণ নুর হোসেন শরিফ। বাড়ি দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরায়। শিক্ষা শেষে উদ্যোক্তা হতে চেয়েছিলেন। তবে স্নাতকোত্তর শেষ করে পারিবারিক আর সামাজিক চাপে হন্যে হয়ে সোনার হরিণ (সরকারি চাকরি) খুঁজে চলেছেন। পাস করার পর থেকে সরকারি চাকরির জন্য এখন পর্যন্ত ১৬০টি আবেদন করেছেন। এতে তার ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার টাকার বেশি। লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন ৬০টিরও বেশি। প্রতিটি পরীক্ষার জন্য তাকে আসতে হয়েছে ঢাকায়। প্রত্যেকবার যাতায়াতে দেড় হাজার টাকা করে ব্যয় হয়েছে ৯০ হাজার টাকার বেশি। এর মধ্যে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় আসতে হয়েছে অন্তত সাত বার। এতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকার বেশি। পাশাপাশি চাকরির জন্য রাজধানী এসে থাকা বাবদ ব্যয় ৩০ হাজার টাকা আর খাওয়া বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার টাকার বেশি।
শুধু সরকারি চাকরি খুঁজতেই আজ অবধি নুর হোসেনের খরচ হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার টাকার বেশি। তারপরও চাকরি হয়নি। আজও আবেদন করেই যাচ্ছেন। আর খরচের জন্য হাত পাততে হচ্ছে পরিবারের কাছে, কখনও ধারদেনা করছেন। চাকরির বয়স শেষ হওয়ার আগে আদৌ তার কপালে সোনার হরিণ জুটবে কিনা তা জানেন না নুর হোসেন।
নুর হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, দুই বছরে সরকারি চাকরির পিছনে দৌঁড়াতে গিয়ে সব মিলিয়ে আমার খরচ হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার টাকার বেশি। যার কিছু অংশ নিতে হয়েছে পরিবার থেকে। কিছু অংশ ধার-দেনা করে। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছি। ভারী হচ্ছে ঋণের পাল্লা।
একই রকম গল্প কুমিল্লা দাউদকান্দির উচ্চ শিক্ষিত তরুণ নওসাদ উল্লাহর জীবনেও। ছয় মাস ধরে তিনি চাকরির আবেদন আর পরপর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে চাকরির জন্য ৩৫টি আবেদন করতে গিয়ে প্রায় ১৪ হাজার টাকা খরচ করেছেন। পরীক্ষা দিয়েছেন ১৩টি। যাতায়াত বাবদ খরচ সাড়ে ছয় হাজার টাকা, থাকা বাবদ প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকাসহ সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন সাখাওয়াত হোসেন। বাড়ি তার মেহেরপুর জেলা সদরের মুজিবনগরে। গত ছয় মাসে চাকরির জন্য ৪০টি আবেদন করেছেন। আবেদন, যাতায়াত, থাকা ও খাওয়া বাবদ তার খরচ হয়েছে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা বেশি। বেশিরভাগ টাকা সংগ্রহ করেছেন টিউশনি থেকে।
বছর কয়েক আগে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা রাফির চাকরির বয়স শেষ। করোনা মহামারির কারণে সরকার যে বাড়তি ছয় মাস সময় বাড়িয়েছিল সেই সময় কাজে লাগাতে চাকরির জন্য একের পর এক আবেদন করে যাচ্ছেন। চাকরির জন্য আবেদন, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে পরীক্ষা দিতে যাওয়া আর থাকা-খাওয়া বাবদ তার কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কখনও টিউশনি করে, কখনও ধারদেনা করে এসব টাকা সংগ্রহ করেছেন। তবে এখন তার চাকরি হয়নি। হবে কিনা তিনি জানেন না।
নুর হোসেন শরিফ, সাখাওয়াত, নওসাদ আর রাফির মতো সারাদেশে লাখ লাখ বেকার তরুণ রয়েছেন। যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটছেন। তাদের বেশিরভাগের লক্ষ্য সরকারি চাকরি পাওয়া। এর মধ্যে মেধাবীদের প্রধান লক্ষ্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) সুযোগ নেয়া। আর চাকরি খুঁজতে গিয়ে শিক্ষিত তরুণদের বহু টাকা খরচ করতে হচ্ছে। যেসব টাকা কেউ পরিবার থেকে, কেউবা টিউশনি কিংবা পার্টটাইম কাজ করে সংগ্রহ করছেন।
গেল কয়েক বছর ধরে বিসিএসে রেকর্ড আবেদন করতে দেখা যাচ্ছে। এখন অবধি সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছিল ৪১তম বিসিএসে। যেখানে আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩তম বিসিএসে। সূত্রমতে, ৪৩তম বিসিএসে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৮৩২ আবেদনকারী থেকে ৭৫০ টাকা হারে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) আদায় করেছে ৩৩ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা।
আরেক তথ্যে দেখা যায়, বিগত ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনে ৮ লাখ ৭৬ হাজার আবেদনকারী থেকে ৩৫০ টাকা হারে ফি বাবদ আদায় হয়েছে ৩০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ১৬তম নিবন্ধনে ১১ লাখ ৭৬ হাজার ৪১ কোটি ১৬ লাখ টাকা, ১৭তম নিবন্ধনে ১১ লাখ ৬৫ হাজার আবেদনকারী থেকে ৪০ কোটি সাড়ে ৭৭ লাখ টাকা, এবং তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে চূড়ান্ত নিয়োগে ৯০ লাখ আবেদনকারী থেকে ১১০ টাকা হারে আদায় করা হয়েছে ৯৯ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু করে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত গত আড়াই বছরে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ এনটিআরসিএ বেকারদের কাছ থেকে আদায় করেছে ২১১ কোটি টাকা। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সর্বশেষ ১১ হাজার শিক্ষকের নিয়োগে আবেদন জমা পড়ে প্রায় ২৬ লাখ। খাদ্য অধিদফতরের এক হাজার ১০০ জন নিয়োগের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে প্রায় ১৫ লাখ। এসব আবেদনে কর্তৃপক্ষ আদায় করেছে কোটি কোটি টাকা।
২০২১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) পরিচালিত এক জরিপে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার। যা মোট শিক্ষার্থীর দুই-তৃতীয়াংশ। জরিপে আরও দেখা গেছে, ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনও অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন।
দেশে বিপুল সংখ্যক উচ্চশিক্ষিত বেকাররা ভালো চাকরির আশায় বছরের পর বছর ধরে আবেদন করতে থাকেন। এসব আবেদনে তাদের প্রচুর ব্যয় হয়। এই ব্যয়ের চাপ পড়ে তাদের পরিবার ও ব্যক্তিজীবনের ওপর। মূলত, চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে। প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন। অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। তবে পরীক্ষার আবেদন এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে তাদের। লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশীদের পকেট থেকে প্রতিবছর ব্যয় কোটি কোটি টাকা।
বেকারত্বের কঠিন সময়ে উচ্চশিক্ষিতদের অনেকে টিউশনি করে আবেদন এবং যাতায়াতের টাকা সংগ্রহ করে থাকেন। তবে করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর টিউশনি করতে পারেননি অনেকে। ফলে বেকারদের সীমাহীন কষ্ট ও দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। সম্প্রতি বগুড়া জেলায় দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে টিউশনির সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয়া আলমগীরের ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
আলমগীরের মতো সারাদেশেই অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ-তরুণী রয়েছেন। যারা চাকরির পিছনে টাকা খরচ করতে করতে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অনেকেই আবার নিজেরা কিছু করার চেষ্টা করছেন। তবে বেশিরভাগের কথা, সামাজিকভাবে এখনও নিজে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি হয়নি। তারা চাইলেও হতে পারছেন না। কারণ তারা পরিবারের কাছে টাকা চাইলে তারা দিতে সক্ষম হচ্ছেন না। সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধাও তারা চাহিদা মতো পাচ্ছেন না। ঋণ নিতে গেলেও ঘাটে ঘাটে হয়রানির শিকার হতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরির নামে এখন বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে এসে চাহিদানির্ভর শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা প্রয়োজন। বাজারভিত্তিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে পারলে সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব বলেও মনে করছেন তারা।
দেশব্যাপী বেসরকারি উদ্যোক্তা তৈরিতে ২০১৯ সালে ৬৪ জন প্রশিক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। উদ্দেশ্য ছিলো দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিনিয়োগে আগ্রহী সম্ভাবনাময় বেকার ও শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বিনিয়োগ-সংক্রান্ত ধারণা দেয়া। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ স্লোগানকে সামনে রেখে উদ্যোক্তাদের ‘চাকরি করবো না, চাকরি দেবো’ এমন মনোভাবে আগ্রহী করে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। ইতোমধ্যেই দুই বছরের জন্য উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন নামে প্রকল্প হাত নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৯৯৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এদেশে শিক্ষিত শ্রমশক্তির বড় একটা অংশ অপচয় হচ্ছে। সরকার শিক্ষাখাতে যে বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে তা কাজে লাগছে না। যার মূল কারণ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে চাকরির বাজারের মিল না থাকা। বাজারে যে ধরণের চাকরি আছে শিক্ষিতদের সে ধরণের ডিগ্রির অভাব রয়েছে। একাডেমিক শিক্ষা অর্জনের পর শিক্ষিত তরুণরা ১০ হাজার টাকা বেতনের চাকরিও খুঁজে পাচ্ছেন না। এর চেয়ে বড় হতাশা আর কিছুই হতে পারে না।
যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আজহারুল ইসলাম খান আনন্দবাজারকে বলেন, একজন শিক্ষার্থী স্নাতক-স্নাতোকত্তর শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটছেন। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকায় সেখান থেকে ছিটকে পড়ছেন। যার অন্যতম কারণ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। আর এ ব্যবস্থাকে কারিগরি শিক্ষার আদলে ঢেলে সাজাতে পারলে বেকার সমস্যা কমে যাবে। সমস্যা নিরসনে যুব উন্নয়ন অধিদফতর শিক্ষিত তরুণ-যুবকদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। তারা নিজেরা যেন কিছু করতে পারে সেজন্য সরকারিভাবে ঋণ সহায়তাও দেয়া হচ্ছে। আমরা চাই তারা চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরা কিছু করুক। তারা কিছু করতে পারলে দেশ ও সমাজের উপকার হবে। বেকার সমস্যা নিরসন হবে।
আনন্দবাজার/শহক