ঢাকা | শনিবার
২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সিরামিকখাত

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সিরামিকখাত

করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দ্রুত সম্প্রসারণমান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। থমকে গিয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে দেশীয় সব ধরনের শিল্পখাত। ব্যাহত হয় আমদানি-রপ্তানি। তবে এতকিছুর মধ্যেও গেল বছরে স্বপ্নের হাতছানি দিয়েছে দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্প সিরামিক খাত। করোনার প্রার্দুভাবের মধ্যেও সিরামিক পণ্য বেচাকেনা ছিল অনেক বেশি। যদিও করোনা মহামারি শুরুর পর পরই সিরামিক পণ্য বিক্রি নেমে যায় ৫০ শতাংশের নিচে। তবে করোনার ধকল কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে তখন সিরামিক খাতে সুবাতাস দেখা দেয়। বেচাবিক্রি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন সিরামিক ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) নির্বাহী সচিব জাহেদী হাসান চৌধুরী দৈনিক আনন্দবাজার বলেন, করোনা মহামারির ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের সিরামিক খাত। বেচাবিক্রির পাশাপাশি কমেছে উৎপাদনও। তবে করোনার সংক্রামণ কমে আসায় গত বছর থেকে বেচাকেনার গতি বেড়েছে।

তথ্যমতে, গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরের (জুলাই-জুন) সিরামিক খাতের কোম্পানিগুলোর অডিট প্রতিবেদন এখনও দেয়া হয়নি। এর ওপর আবার চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসও (জুলাই-ডিসেম্বর) কেটে গেছে। অডিট না হওয়ায় করোনার ধাক্কায় সিরামিক খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো তথ্য হতে নেই। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, করোনা মহামারির কারণে গত বছরে ৩০ ভাগ লোকসান গুণতে হচ্ছে সিরামিক খাতে।

সিরামিকখাতের উদ্যোক্তা ও পণ্য উৎপাদনকারীরা বলছেন, তারা এখনও পুরোপুরি উৎপাদনে যেতে পারেননি। বাজারে সিরামিক পণ্যের চাহিদা থাকলেও পর্যাপ্ত সরবরাহ করা যাচ্ছে না। উৎপাদিত পণ্যের অনেক কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। তাছাড়া করোনার কারণে এখনও অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কাস্টমসেও কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। কাঁচামাল আনতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকায় কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে। অনেক এলাকায় গ্যাসের চাপ পাওয়া যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিরামিক কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা ভেদে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট) পর্যন্ত লোড অনুমোদন করা থাকলেও গ্যাসের চাপ কখনো কখনো ৭ পিএসআইয়ের কোটায় নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও চাপ আরো কম। এতে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থায়ী সমাধান চাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।

গ্যাস সংকট প্রসঙ্গে বিসিএমইএর নির্বাহী সচিব জাহেদী হাসান চৌধুরী বলেন, গত বছরে ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও ভালুকা এবং গাজীপুরের মাওনা, শ্রীপুর, জয়দেবপুর, ভবানীপুর ও ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকার কারখানাতে গ্যাস সংকট দেখা দেয়। এতে তৈজসপত্র, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার কারখানায় উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হয়। পরে স্বাভাবিক চাপে গ্যাস সরবরাহের জন্য জরুরি পদক্ষেপ চেয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দিয়েছি। তিতাস সেই সমস্যার সমাধান করেছে। বর্তমানে এসব এলাকার কারখানাগুলোতে গ্যাসের কোনো সংকট নেই। জাহেদী হাসান চৌধুরী আরও বলেন, সিরামিক পণ্য তৈরিতে গ্যাসের প্রয়োজনীয় চাপ অনেক জায়গায় কম থাকার অভিযোগ উঠেছে। সেসব অভিযোগ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেছি।

সিরামিক পণ্য উৎপাদনকারীদের দেয়া তথ্যমতে, দেশে সিরামিক খাতে মোট বিনিয়োগের ৫৯ শতাংশই করা হয়েছে টাইলস পণ্য উৎপাদনে। উৎপাদিত টাইলস স্থানীয় বাজারের চাহিদার ৮৪ শতাংশ পূরণ করছে। বাকি পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। আবার সিরামিক খাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ তার মধ্যে ২৪ শতাংশ রয়েছে গৃহস্থালী বা তৈজসপত্র পণ্যে। যা স্থানীয় বাজারের চাহিদার ৭৩ শতাংশ মেটাচ্ছে। এছাড়া সিরামিক খাতের বিনিয়োগের ১৭ শতাংশ রয়েছে স্যানিটারিওয়্যার পণ্যে। যা স্থানীয় বাজারের চাহিদার ৬৬ শতাংশ পূরণ করছে। বাকি অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে।

তথ্যমতে, সিরামিক খাতের টাইলস পণ্য স্থানীয় বাজারে ব্যাপক দাপট দেখালেও রপ্তানিতে এগিয়ে রয়েছে তৈজসপত্র বা গৃহস্থালী পণ্য। গৃহস্থলীর বিভিন্ন পণ্যের অবস্থান স্থানীয় বাজারে ভালো না থাকলেও বিদেশে চাহিদা রয়েছে। সিরামিক খাতের ৯৮ শতাংশ গৃহস্থালীর বিভিন্ন জিনিসপত্র পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। বাকি ২ শতাংশ টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার পণ্য।

ফু-ওয়াং সিরামিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রফিকুজ্জামান ভূঁইয়া দৈনিক আনন্দবাজার বলেন, দেশে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে সিরামিক খাতের মধ্যে টাইলস পণ্য। বর্তমানে ৩০টি প্রতিষ্ঠান টাইলস পণ্য উৎপাদন করছে। এতে বিনিয়োগ ৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকার মতো। টাইলস স্থানীয় বাজারের চাহিদার ৮৩ দশমিক ৭৯ শতাংশই পূরণ করছে। করোনা শুরুর পর লকডাউনে টাইলস পণ্য বিক্রি কমে গেলে পরে বিক্রি বেড়েছে।

যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের বিপরীতদিকে ইয়ানূর টেডিং কর্পোরেশনের সিরামিক ব্যবসায়ী মো. মহিউদ্দিন মিয়া বলেন, দেশে করোনা শুরু ২০২০ সালের মার্চ মাসে। তখন লকডাউনে আমাদের সিরামিক মার্কেটের সব দোকান বন্ধ ছিল। দীর্ঘদিন লকডাউনের পর সরকার তা তুলে নেয়। এরপর থেকে সিরামিক পণ্য ফের বিক্রি শুরু হয়। সে সময় বিক্রির গতি খুবই মন্দা ছিল। তবে ২০২১ সাল থেকে সিরামিক পণ্য বিক্রি বেড়ে যায়।

একই মার্কেটের সাকিব এন্টারপ্রাইজের সেলসম্যান রাব্বি বলেন, করোনার শুরু হবার আগের মতো বিক্রি এখনও ফিরে আসেনি। করোনা শুরুর পর যেভাবে সিরামিক পণ্য বিক্রি কমেছিল, এখন সেই অবস্থা থেকে ফিরতে শুরু করেছে। করোনায় আটকে থাকা নির্মাণকাজ ফের শুরু হয়েছে। তাই সিরামিক পণ্য বিক্রি হচ্ছে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে সিরামিক পণ্য বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। তবে লাভ সেই তুলনায় হচ্ছে না। বর্তমানে টাইলস পণ্য বেশি বিক্রয় হচ্ছে। এরপর বিক্রি হচ্ছে স্যানিটারিসামগ্রী।

অপরদিকে, এলিফ্যান্ট রোডের গৃহস্থলীর বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রয় কেন্দ্রের একাধিক সেলসম্যান বলেন, করোনার শুরুর প্রথম দিকে বিক্রি ছিল না বললেই চলে। সিরামিকের ডিনার সেট, টি সেট, কফি মগ, প্লেট, বাটি ইত্যাদি পণ্য বিশেষ ছাড় দিয়েও তেমন ক্রেতা পাওয়া যায়নি। তখন দোকানের দৈনিক খরচ তুলতে হিমশিম খেতে হয়েছে। বর্তমানে সেই অবস্থা থেকে কিছুটা রেহাই পেয়েছি। এখন বিক্রয় হচ্ছে। দোকানের দৈনিক ব্যয় তুলা যাচ্ছে।

বিসিএমইএর সবশেষ তথ্যানুযায়ী, (২০১৯-২০২০ অর্থবছর), সিরামিক খাতটিতে বিনিয়োগ (দেশি এবং বিদেশি) পরিমাণ ৮ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ বাজার টাইলসের। পাঁচ হাজার ২৩৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ। স্যানিটারিওয়্যারে ১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা এবং তৈজসপত্র দুই হাজার ১৭৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ। বছরে স্থানীয় বাজারে ৫ হাজার ১৯৬ কোটি টাকার সিরামিক পণ্য বিক্রি হয়েছে। স্থানীয় বাজারে টাইলস বিক্রি ৩ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা, স্যানিটারিওয়্যার ৮৬১ কোটি এবং তৈজসপত্র ৪৮০ কোটি টাকার।

তথ্যমতে, সিরামিক খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ লাখ (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) কর্মীর। এর মধ্যে নারী কর্মী ২০ শতাংশ। সিরামিক পণ্য উৎপাদনের জন্য দেশে ৬৮টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি গৃহস্থলীর বিভিন্ন জিনিসপত্র (তৈজসপত্র), ৩০টি টাইলসের ও ১৮টি স্যানিটারিওয়্যার প্রতিষ্ঠান। আমেরিকা, জার্মানি, জাপান, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ ৫০টির অধিক দেশে সিরামিকের পণ্য রপ্তানি হয়।

রপ্তানিকৃত সিরামিক পণ্যের ৮০ শতাংশই রপ্তানি হয়েছে ইতালি, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা ও সুইডেনে। বাংলাদেশের সিরামিক সামগ্রী বাজারজাতকরণে প্রধান প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো হলো শ্রীলংকা, চীন, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া। টাইলস, বেসিন, কমোড, কিচেন ওয়্যার, স্যানিটারি ওয়্যার, টেবিল ওয়্যার, মাটির জার, কলস, ফুলের টব, মটকা, টেবিল ওয়্যার, গার্ডেন পট, ভেজ, কিচেন ওয়্যার, ডিনার সেট, টি সেট, কফি মগ, প্লেট, বাটি থেকে শুরু করে গৃহস্থলীর বিভিন্ন জিনিসপত্র সিরামিক দিয়ে তৈরি হচ্ছে। শাইনপুকুর, মুন্নু, বেঙ্গল ফাইন, স্টান্ডার্ড, পিপলস এবং ন্যাশনাল সিরামিক প্রতিষ্ঠান তৈজসপত্রের উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। আরএকে, ফু-ওয়াং, চায়না-বাংলা, ফার, মধুমতি, এটিআই, সানফ্লাওয়ার, গ্রেটওয়াল, ঢাকা-সাংহাই এবং মীর কোম্পানি টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদন করছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন