ঢাকা | রবিবার
২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরিবেশ দূষণের ‘বিষ’ খাদ্যশস্যে

পরিবেশ দূষণের ‘বিষ’ খাদ্য বাসমতি চালে সিসাশস্যে

বিভিন্ন ধরনের চাল আর হলুদের পর এবার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ভারী মৌলিক পদার্থ সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে বাসমতি (কোহিনুর) চালে। দেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি সিসা পাওয়া গেছে। সহনীয় মাত্রা শূন্য দশমিক শূন্য এক হলে বাসমতিতে তা শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ (পিপিএম)। এর আগে বিভিন্ন ধরনের চাল, হলুদসহ এগ্রোকেমিক্যালে মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। অসহনীয় সিসার কারণে বাজারে ২২০ টাকা কেজির বাসমতি চাল এখন অনেকটা ত্রাসে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)র পুষ্টি বিভাগের পরিচালক ড. মো. মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পরিচালিত সমীক্ষায় এমন ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছে। ড. মনিরুল বলছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই অন্যান্য খাদ্যশস্যের মতো বাজারে পাওয়া চালকেও অনিরাপদ হিসাবে মনে করা হচ্ছিল। বিশেষ করে মোম পোলিশযুক্ত চালে মাত্রাতিরিক্ত ভারী ধাতুর উপস্থিতির বিষয়টা আলোচনায় ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিএআরসির পুষ্টি ইউনিট স্থানীয় বাজারে পাওয়া ও আমাদানি করা বিভিন্ন ধরনের চালের নমুনা সংগ্রহ করে ভারী ধাতুর উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।

সমীক্ষার ফলাফল থেকে বলা হয়, সিসা বা ভারী ধাতু লেড বেশ মারাত্মক। এটি দেহের বিশেষ করে মস্তিষ্ক, যকৃত, কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এসব অঙ্গের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যাহত করে। সেই সঙ্গে দাঁত ও হাড়ে জমা হয়ে অস্টিওপরোসিস জাতীয় রোগ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অন্যান্য ভারী ধাতুর মতো ক্যাডমিয়ামও এমন একটি বিষাক্ত ধাতু যা শ্বাসনালী, কিডনি, যকৃতের ক্ষতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ক্যাডমিয়াম ক্যান্সার সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। মূলত হেক্সাভেলেন্ট ক্রোমিয়াম মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অপরপক্ষে ট্রাইভেরেন্ট ক্রোমিয়াম মানবদেহে অপরিহার্য খনিজ হিসেবে কাজ করে।

গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ভারী ধাতুগুলোর প্রধান উৎস ভূগর্ভস্থ পানি বা মাটি। যা মূলত শিল্প কলকারখানার বিভিন্ন বর্জ্য থেকে দূষিত হয়। সে কারণে ওইসব এলাকায় উৎপাদিত খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা বজায় রাখতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। যাতে কোনোভাবে সেই অঞ্চলের পরিবেশ দূষণ না ঘটে। পাশাপাশি কৃষি জমিতে নিম্নমানের সার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। বিভিন্ন শিল্প কারখানার বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা সম্পর্কে কারখানা কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে। একইসঙ্গে বিধি-মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সূত্রমতে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে অজৈব আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেশি। যা জৈব আর্সেনিকের চেয়ে মারাত্মক ক্ষতিকর। বাংলাদেশের ১৬টি অঞ্চল বিশেষ করে চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, মুন্সীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, নোয়াখালি, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মেহেরপুর, বাগেরহাট জেলায় আর্সেনিকের মাত্রা তুলনামূলক বেশি। অজৈব আর্সেনিকযুক্ত পানি বা খাবার শরীরে দীর্ঘদিন ধরে জমা হওয়ার ফলে চর্ম ক্যান্সার, ক্ষত ইত্যাদি ছাড়াও ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ হতে পারে।

খাদ্যশস্যে ভারী ধাতুর উপস্থিতি বিষয়ে গবেষণাকাজে ঢাকার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, মিরপুর-১, মালিবাগ, কাওরান বাজার, ফার্মগেট ও বিভিন্ন চেইন শপ হতে স্থানীয় ও আমদানি করা মোট ১৩ ধরনের চালের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। যার মধ্যে ব্রি ধান-২৮, গুটি, পায়জাম (সেদ্ধ), পায়জাম (আতপ), আমন, মিনিকেট, বাসমতি, বাঁশফুল, নাজিরশাইল, টিলডা (বাসমতি), ফরচুন (বাসমতি), কহিনূর (বাসমতি) ও বিরুই চাল নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বাসমতি চালে মাত্রাতিরিক্ত ভারী মৌল সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।

গবেষকদলের প্রধান ড. মনিরুল বলেন, স্থান ভেদে মাটি ও পানিতে ভারী ধাতুর পরিমাণের ভিন্নতা দেখা যায়। এসব ভারী ধাতু মাটি বা পানি থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে বিস্তৃত হওয়ার মাধ্যমে খাদ্যশস্যে জমা হয়। গবেষণাকালে সংগ্রহ করা প্রতিটি নমুনা বিশ্লেষণে তিনবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। সংগ্রহ করা নমুনা বিশ্লেষণে একমাত্র আমদানি করা কোহিনূর বাসমতি চালেই ভারী ধাতুর পাওয়া গেছে। কোহিনূর বাসমতি চালের পরীক্ষা করা নমুনায় প্রতি কেজি চালের ক্ষেত্রে ০.৪৮ মিলিগ্রাম (পিপিএম) সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়। যা মানবদেহের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ গ্রহণ মাত্রার চেয়ে বেশি।

ইউনাইটেড স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব এগরিকালচার (ইউএসডিএ)র তথ্য অনুসারে, চালে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ছাড়াও কিছু মৌলিক পদার্থ বিদ্যমান। এ পদার্থগুলো কোনো খাদ্যদ্রব্যে নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি পাওয়া গেলে ঐ খাদ্যদ্রব্য অনিরাপদ বলে আখ্যায়িত হয়। আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সিসা বা লেড ইত্যাদি মৌলিক পদার্থগুলোকে ভারী ধাতু বলা হয়। ভারী ধাতুগুলো প্রকৃতিতে জৈব ও অজৈব অবস্থায় পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর হল অজৈব ধাতুগুলো। ভারী ধাতুগুলো চালে জৈব অবস্থায় নির্দিষ্ট পরিমাণে থাকে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে বিষক্রিয়ার মূলনীতি অনুযায়ী ‘মাত্রাতিরিক্ত সকল কিছুর বিষক্রিয়া রয়েছে’। অজৈব ধাতুগুলো মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তা বের হতে পারে না। ফলে মানবদেহে দীর্ঘদিন ধরে জমা হয়ে কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চালে ক্যাডমিয়ামের প্রধান কারণ কৃষি জমিতে নিম্নমানের টিএসপি সার প্রয়োগ এবং বিভিন্ন প্রকার ওষুধ কারখানা, টেক্সটাইল মিল ও শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক ও অপরিশোধিত বর্জ্য। এ জন্য প্রতিটি শিল্প-কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার অর্থাৎ ইটিপি (ইফফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা জরুরি।

এর আগে ২০১৮ সালের ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের পাবমেডি জার্নালে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ-আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় চাল, হলুদ ও এগ্রোকেমিক্যালে মাত্রাতিরিক্ত সিসা (লেড)র উপস্থিতি পাওয়া যায়। তখন ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ এলাকা থেকে নেয়া ৩৮২টি এগ্রোকেমিক্যাল নমুনার মধ্যে ১২৯ জাতের চালে সিসা পাওয়া যায়। ১৭টি হলুদের নমুনা থেকে একটিতে মাত্রাতিরিক্ত সিসা ও ক্রোমিয়াম পাওয়া যায়।

গবেষকরা ওই এলাকার মাটি, পানি, হলুদ, চাল, দেশীয় ওষুধ ও কৃষিজাত ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বিভিন্ন ‘ক্যান’ পরীক্ষা করে সিসার উপস্থিতি খুঁজে বের করেন। সেখানে ৪৩০ জন গর্ভবতী নারীর রক্ত পরীক্ষা করে ১৩২ জনের মধ্যে উচ্চমাত্রার সিসার উপস্থিতি পান। ক্যানজাত খাবার অথবা পণ্য থেকে গর্ভবতীরা ২.৫ শতাংশ বেশি সিসা পাচ্ছে। ওই এলাকায় কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত বাসুডিন থেকে ৩.৬ শতাংশের বেশি সিসা আসে নারীদের রক্তে। মেশিনে ভাঙানো চালে ৩.৩ শতাংশের বেশি এবং ২৮টি ক্যানজাত ফুডের মধ্যে পাঁচটিতেই পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত সিসাযুক্ত রং (ঝালাই করার রঙ)।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (হু/এফএও) গবেষণা এবং ইউরোপিয় কমিশনের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের চালে ক্যাডমিয়াম ও সিসার ক্ষেত্রে মানবদেহের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ নিরাপদ গ্রহণ মাত্রা ০.২ পার্টস পার মিলিগ্রাম (পিপিএম), আর্সেনিকের ক্ষেত্রে ১.০ পিপিএম এবং ক্রোমিয়ামের ক্ষেত্রে ১.০ পিপিএম। বলা ভালো যে, পার্টস পার মিলিগ্রাম-পিপিএম, একক আয়তনের পানিতে কত ভরের কেমিক্যাল বা কন্টামিনেট আছে তা বোঝাতে এই একক ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ যদি ৪ ফোঁটা কালি ৫৫ গ্যালন ব্যারেল পানিতে মেশানো হয় তাহলে ১ পিপিএম ঘনমাত্রার কালির দ্রবণ হবে।

আমদানি করা চালে ক্ষতিকর ধাতুর উপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান দৈনিক আনন্দবাজার বলেন, আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি পর্যবেক্ষণ করে এসব চাল আমদানি করা হয়ে থাকে। তবে বাসমতি চালে মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, চাল আমদানির বিষয়টি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। তবে আমদানির ক্ষেত্রে আমাদের যে অনুমোদন প্রয়োজন সেখানে চালটি স্বাস্থ্যপোযুগী কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলা হয়ে থাকে। এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুদার, এমপি ও খাদ্য সচিব ড. মোছামাৎ নাজমানারা খানুমের সঙ্গে একাধিক বার যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, আমদানির সময় সেসব দেশে ভারী ধাতুর মাত্রাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই কিনতে হবে। যাতে আমরা কোনো ধরনের ক্ষতির মুখে না পড়ি।

বিগত ২০১৯ সালের অক্টোবরে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছিল, খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে দেশে প্রতিবছর অন্তত ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ক্যান্সার, ২ লাখ ২০ হাজার ডায়াবেটিস এবং ২ লাখ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও প্রায় পৌনে তিন লাখ মানুষ ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রে এবং পেটের পীড়া, লিভার, অ্যালার্জিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে দেশের লাখ লাখ মানুষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর চার লাখ ৯৪ হাজার মানুষ সিসার ক্ষতিকর প্রভাবে মারা যায়। তার ওপর প্রায় ৯৩ লাখ মানুষ সিসার কারণে দীর্ঘকালীন নানা সমস্যা যেমন, নানা রকম দৈহিক বৈকল্যে ভোগে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন