ঢাকা | শুক্রবার
২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফিডের চাপে সম্ভাবনা ফিকে

ফিডের চাপে সম্ভাবনা ফিকে

দেশে দৈনিক মুরগির মাংসের উৎপাদন ১৭০০ টন, ডিম সোয়া দুই কোটি, একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন এক কোটি। মাংসের মোট চাহিদার ৪০-৪৫ ভাগের জোগান দিচ্ছে পোল্ট্রিখাত। চাহিদার শতভাগ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিডই উৎপাদিত হচ্ছে দেশে।

প্রাচীনকালে মানুষ বনে-জঙ্গলে লতা-পাতা, পশু-পাখি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতো। সভ্যতার বিবর্তনে মানুষ ধীরে ধীরে রান্না করে খাওয়া শিখলো। এরপর সময়ের বদলে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের উন্নতিতে মানুষ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের অন্বেষণে নামে। শুরু হয় পুষ্টির চাহিদা মেটানোর নানা পরিকল্পনা। একসময় মানুষ বন্যপ্রাণি ধরে পোষ মানাতে শুরু করে। যা পুষ্টি চাহিদার বড় জোগান দিতে শুরু করে। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে পোল্ট্রি খাত। বিগত শতকের ১৯২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পোল্ট্রি ধারণাটির সূত্রপাত ঘটে।

সূত্রমতে, বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে পোল্ট্রির ধারণা শুরু হয়। স্বাধীনতার আগে ১৯৬০ সালের দিকে বিচ্ছিন্নভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক পোল্ট্রি খামারের সূচনা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পোল্ট্রি বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে ১৯৬৮ সালে। তবে দেশে বাণিজ্যিকভাবে ব্রয়লার, লেয়ার শিল্পখাতের যাত্রা শুরু হয় আশির দশকে। যা নব্বই দশকে এসে গতিশীলতা লাভ করে। দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পোল্ট্রিখাত এখন অর্থনীতিতে গুরুত্বর্পুণ অবদান রেখে চলেছে।

শিল্পখাতে জড়িতদের দেয়া তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মাংসের মোট চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশেরই জোগান দিচ্ছে পোল্ট্রিখাত। বর্তমান বাজারে যে পরিমাণ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিডের প্রয়োজন তার শতভাগ এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন এক হাজার ৭শ’ মেট্রিক টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে দুই থেকে সোয়া দুই কোটি। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি।

মূলত, পোল্ট্রি শিল্প দেশের অপার সম্ভাবনাময় ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানমুখী সমৃদ্ধ এক খাত। গেল কয়েক দশকে দেশে আন্তর্জাতিকমানের বহু পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে। যা আগে কেউ চিন্তাও করতে পারেননি। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে এ খাত দেশে নতুন এক বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে। এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে পোল্ট্রি খামার নেই। চাকরির প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীসহ হাজার হাজার নারী-পুরুষ ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে এ শিল্পে নিজেদের নিয়োজিত করছে। এ খাত এখন সমৃদ্ধ অর্থকরী শিল্পে পরিণত হয়েছে।

তবে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির সময়ে এসে সবচেয়ে হুমকির মুখে পড়েছে এ খাতটি। বিগত ২০২০-২১ সালে করোনাকালে বিভিন্ন পেশা থেকে ছিটকে পড়া অনেকেই পোল্ট্রি খামারে আত্মকর্মসংস্থান খুঁজে নিয়েছে। যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশই নারী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে পোল্ট্রি শিল্প। এ শিল্প পরিচালনা, পরিচর্যা, বাজারজাতকরণ ও খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রমে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপক প্রসার ঘটছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, দেশে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে পোল্ট্রি শিল্প। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এ শিল্পে ছোট-বড় খামার রয়েছে প্রায় ৭০ হাজারের বেশি। যদিও খামারিদের হিসাবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। ক্রমবর্ধমান এই শিল্পে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় এক কোটি মানুষের। পাশাপাশি প্রায় এক লাখ প্রাণীচিকিৎসক, পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ, নিউট্রিশনিস্ট সরাসরি এ খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। এতে দেশে পোল্ট্রি শিল্পের যেমন দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটেছে, তেমনি বিনিয়োগও বেড়েছে চলেছে। বর্তমানে এ খাতে বিনিয়োগ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ২৭ লাখ টন। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ফিড মিলে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ২৫ দশমিক ৫০ লাখ টন এবং স্থানীয় উৎপাদন প্রায় এক দশমিক ৫০ লাখ টন। বর্তমান বাজারে মুরগির মাংস ও ডিম সবচেয়ে নিরাপদ খাবার। প্রাণিজ আমিষের সবচেয়ে বড় যোগানদার হলো পোল্ট্রিখাত। দেশীয় পুঁজি ও উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ শিল্প দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে বিরাট ভূমিকা রাখছে।

তবে প্রান্তিক খামারিরা বর্তমানে নানা সংকটে পড়েছেন। তাদের অভিযোগের তীর খাবারের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়া ও একই সঙ্গে এ খাতের সিন্ডিকেটের দিকে। তারা বলছেন, বর্তমানে এক বস্তা ব্রয়লায় খাবারের দাম ২৭৭৫ টাকা। একবস্তা লেয়ার স্টাটার খাবারের দাম ২৫০০ টাকা টাকা, লেয়ার গ্রোয়ারের দাম ২৪০০ টাকা এবং লেয়ার-১ এর দাম ২৩৫০ টাকা। একবস্তা সোনালী খাবারের দাম ২৪৭৫ টাকা। অথচ আজ থেকে এক দশক আগে এই দাম ছিল মাত্র ১২০০ টাকা। গত দেড় বছরে প্রতিবস্তা খাবারের দাম বেড়েছে প্রায় ৫৫০ টাকা করে। অথচ মুরগি বা ডিমের দাম বেড়েনি সে হারে। মুরগির খাবারের দামের সঙ্গে মুরগি বা ডিমের দামের সঙ্গতি না থাকায় প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা ক্রমশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ছেন।

পোল্ট্রিশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি, গ্রামীণ পর্যায়ে এই শিল্পের কল্যাণে যুব নারী ও যুবকেরা নিজেদের জীবনমানের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা রাখছেন। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও খাদ্য হিসেবে পোল্ট্রির কদর দিন দিন বাড়ছে। কারণ মানুষ এখন সাদা মাংস চায়। গরু, ছাগল থেকে আসে লাল মাংস। এতে ক্যালরি ও চর্বির মাত্রা বেশি। দামও বেশি। তবে সাদা মাংসে ক্যালরি ও চর্বির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। এর দামও কম। তাই বাজারে ডিম ও ব্রয়লার মাংস চাহিদা বেশি।

পোল্ট্রি খাবারে করমুক্ত ও ভর্তুকি দিয়ে হলেও খাবারের মূল্য কমানো প্রয়োজন। এছাড়া বৈদ্যুতিক বিল প্রথম ইউনিটের মতো পরবর্তী ইউনিটের বিলও রাখা হলে খামারিদের অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক বিল গুণতে হবে না। এতে খামারিদের এ শিল্পে আগ্রহ বাড়াবে। মানুষের আয় বৃদ্ধি ও জীবনমানের উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আগামীতে পোল্ট্রির চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পাবে। সেই চাহিদা মেটানোর জন্য পোল্ট্রি উৎপাদনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা দরকার।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন