বিশ্ববাজারে পোশাক রফতানিতে বিগত কয়েক বছর ধরেই ভিয়েতনাম আর বাংলাদেশের মধ্যে অলিখিত এক প্রতিযোগিতা চলছে। পোশাক রফতানিতে অপ্রতিরোধ্য চীনের পরের স্থানটিতে কখনও ঢাকা, কখনও আবার হ্যানয় এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে। তবে পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে বৃহৎ রফতানিকারক দেশ হিসেবে চীনের বাজার দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে, রফতানির দিক দিয়ে একুশ শতকে বিশ্বের ভরকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ভিয়েতনাম বেশ চমক দেখিয়ে চলছে। উদ্ভাবন, বৈচিত্র আর দক্ষতার চমকে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর। তবে এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ তার অবস্থান শক্ত করে ধরে রেখেছে।
বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়াবহতার মধ্যে ২০২০ সালে পণ্য রফতানি কমে যায় প্রায় ৭ দশমিক ৮ ভাগ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রফতানি-হ্রাসের হার ছিল ১৭ শতাংশ। তবে বিপরীত দিকে ভিয়েতনামের মোট পণ্য রফতানি বেড়ে যায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। টাকার অংকে যা প্রায় ২৩ লাখ ৮৭ হাজার ৯৫৭ কোটি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে তার অবস্থানের চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়। মাত্র ৯ কোটি ৬৪ লাখ মানুষের দেশ ভিয়েতনামের এই অগ্রগতি বিস্ময় জাগায় অনেকের।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিক্যাল রিভিউ অনুযায়ী, বিগত ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তিন নম্বরে। ১৪২ বিলিয়ন ডলারের পোশাকপণ্য রফতানি করে চীনের অবস্থান শীর্ষে। বিশ্ববাজারে দেশটির অংশীদারিত্ব ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশকে টপকে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসা ভিয়েতনামের রফতানির পরিমাণ ছিল ২৯ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ববাজারে দেশটির অংশীদারিত্ব বেড়ে ৬ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ২৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ অংশীদারিত্বে ছিল। যা আগের বছরের চেয়ে দশমিক ৫ শতাংশ কম।
তবে অনানুষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের প্রথম সাত মাসে পোশাক রফতানিখাতে ভিয়েতনামের চেয়ে এক দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার বেশি আয় করে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থান পুনরুদ্ধার করে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) এক প্রতিবেদন অনুসারে বস্ত্রখাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ১২টি মানদণ্ডের ১০টিতেই ভিয়েতনামের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এসব মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে, পণ্যের গুণমান, ‘লিডটাইম’ এবং টেকসইতার দিক। পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে ‘লিড টাইম’ মূলত কার্যাদেশ দেওয়া এবং ‘ফিনিশড প্রোডাক্ট’ সরবরাহের মধ্যবর্তী সময়। প্রতিবেদন মতে, কাঁচামালের সোর্সিংয়ে ভিয়েতনামের সক্ষমতা বেশি বাংলাদেশের চেয়ে। তাছাড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নিজেদের বন্দরে আমদানি করা চালান ছেড়ে দিতে পারে তারা। অথচ বাংলাদেশের সেখানে সময় লাগে ৪৮ ঘণ্টা থেকে এক মাস অবধি।
স্থানীয় পোশাক কারখানার মালিকদের দেয়া তথ্যমতে, ভিয়েতনামের শ্রমিকরা উৎপাদনে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি দক্ষ। আমাদের চেয়ে তারা ১০ থেকে ১৫ দিন আগে ইউরোপীয় ক্রেতাদের কাছে চূড়ান্ত পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। আবার ভিয়েতনাম সরাসরি নিজেদের সমুদ্রবন্দর থেকে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠালেও বাংলাদেশ তাতে সক্ষম হয় না। গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় ফিডার ভেসেলগুলোকে পণ্য নিয়ে প্রথমে সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে যেতে হয়। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকায় চালানের জন্য পণ্য মাদার ভেসেলে স্থানান্তর করা হয়।
ডব্লিউটিওর প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে অন্তত ১৫০ রফতানিকারক ও ৩০টি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও বিক্রেতার ওপর জরিপ চালিয়ে। প্রতিবেদনের অন্যান্য প্রধান মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে, মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা, উদ্ভাবন, দক্ষতা, কার্যাদেশের পরিমাণের ফ্লেক্সিবিলিটি, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। শুধুমাত্র শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ও সস্তা শ্রমের কারণে মাত্র দুটি সূচক মূল্য ও শুল্ক সুবিধায় বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ও চীনের চেয়ে এগিয়ে। তাছাড়া অন্যসব গুলোতে পিছিয়ে রয়েছে। এশিয়ার অন্য তিন স্বল্পোন্নত দেশ কম্বোডিয়া, লাওস ও নেপালের তুলনায় মাত্র কয়েকটি সূচকে খানিকটা এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিখাত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ দশ সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে অন্তত এক স্কোর এগিয়ে রয়েছে ভিয়েতনামের ফ্যাশন শিল্প। টেকসইতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ব্যবধান যথাক্রমে ১.৫ ও ২।
এফটিএতে পিছিয়ে
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর বড় সুবিধা হলো পোশাক খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) শক্তিশালী উপস্থিতি। এটি এই দেশগুলোকে উন্নত মান এবং দর কষাকষির ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ইইউয়ের পোশাকের বাজারে বাংলাদেশ সম্ভবত অগ্রাধিকার সুবিধা হারাবে। কিন্তু উন্নয়নশীল ভিয়েতনাম এফটিএ (মুক্তবাণিজ্য চুক্তি) করায় শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে।
পোশাকশিল্পের নেতারা বরাবরই এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে আসছেন। যদিও কয়েক বছর ধরে বস্ত্রখাতে বিদেশি বিনিয়োগ আনার কথা বলছেন তারা। তবে সেটিও জোরকদমে এগোচ্ছে না। ফলে সস্তা পোশাকের বাইরে বড় আকারে নতুন পণ্য উৎপাদনে যেতে পারছে না বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভিয়েতনাম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। তাদের পোশাক ও বস্ত্র খাতের অধিকাংশ বিনিয়োগই বিদেশি।
মূলত, ২০১০ সালে তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক রফতানি বাজারে ৪ দশমিক ২ শতাংশ অংশীদারিত্ব অর্জন করে তুরস্ককে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে এসেছিল বাংলাদেশ। এরপর থেকে এই অবস্থানেই ছিল। তখন তুরস্কের অবস্থান ছিল ৩, ভারতের অবস্থান ছিল ৪। ওই সময় বিশ্ববাজারে ভিয়েতনামের অবস্থান ছিল তাদের পেছনে। তবে করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুতে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় ২০২০-এর এপ্রিলে বাংলাদেশের রফতানি আয় তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তাতে ভিয়েতনাম পেছন থেকে উঠে এসে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যায়। তবে এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশেরও পোশাক রফতানি বাড়তে থাকে।
কার্যাদেশের আকর্ষণ থাকবে
ডব্লিউটিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা খরচ, স্পিড টু মার্কেট, ফ্লেক্সিবিলিটি, তৎপরতা এবং কমপ্লায়েন্স ঝুঁকিসহ বিভিন্ন সোর্সিংয়ের ওপর জোর দেয়। তারা চীন ও ভিয়েতনামকে ক্রিটিক্যাল সোর্সিং ভিত্তি হিসেবে দেখে। আর বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস, নেপালের মতো স্বল্পোন্নত দেশকে দেখে তাদের বিভিন্ন সোর্সিংয়ের অংশ হিসেবে। ইইউভিত্তিক ফ্যাশন কোম্পানিগুলোর আরেকটি প্রধান সোর্সিং গন্তব্য হলো তুরস্ক। আর সীমিত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে ইইউভিত্তিক ক্রেতারা বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস এবং নেপাল থেকে কমপ্লেক্স পণ্য (পোশাক এবং বহির্বাস) কম কেনে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরেও বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, লাওস ও নেপাল ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় সোর্সিং গন্তব্য মনে হতে পারে। তাদের বিশ্বাস, এলডিসি থেকে উত্তরণ এসব দেশের সোর্সিংকে খানিকটা প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়া আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া থেকে তারা তাদের সোর্সিং আরো বাড়াবে।
আনন্দবাজার/শহক