দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এমন পরিসংখ্যানে দেশের অর্থনীতিতে পুরুষের সমানে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার কথা। তবে তা যদি না হয়, তাহলে উন্নয়ন পিছিয়ে যাবে। দেশের অর্ধেক মানুষের মেধা ও শ্রম অলস পড়ে থাকলে কিংবা অব্যবহৃত থাকলে দ্রুতগতির অর্থনীতি থমকে যাবে। এ কারণেই নারীর আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রয়োজন নারী উদ্যোক্তা। যাদের হাত ধরে দেশীয় অর্থনীতি যেমন গতি পাবে, তেমনি সামাজিক বৈষম্য কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই ‘নারী উদ্যোক্তা নগরী’ গড়ার ধারণাও দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত খুচরা ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান ছিল ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি। যেসব প্রতিষ্ঠানে পুরুষ উদ্যোক্তার সংখ্যা দেড় কোটির মতো হলেও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা মাত্র দুই লাখের কিছু বেশি। হিসাবে দেখা যায়, নারী উদ্যোক্তার চেয়ে পুরুষ উদ্যোক্তার সংখ্যা এক কোটি ৩৭ লাখ বেশি। এমন পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী হলেও উদ্যোক্তা হিসেবে তারা অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
সূত্রমতে, দেশের মোট নারী জনসংখ্যার মাত্র ক্ষুদ্র একটি অংশই কর্ম প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত। বৃহৎ সংখ্যক নারী এখনো ঘর-সংসার নিয়েই পড়ে আছেন। যাদের মধ্যে বড় একটা অংশ উচ্চশিক্ষিত কিংবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দারুণ দক্ষ। যাদের মেধা ও শ্রম অব্যবহৃত রয়ে গেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, গত প্রায় দুই দশকে নারীর উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। অনেকেই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেন। কেউ ক্ষুদ্র পরিসরে কেউ বড় পরিসরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার চেষ্টা করছেন।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত দেড় দশকে পুরুষের তুলনায় নারী উদ্যোক্তা অনেক বেড়েছে। দুই দশক আগে ২০০২-০৩ অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিল মাত্র ২২ হাজারের মতো। অথচ পরবর্তী প্রায় এক দশক পর ২০০৯-১০ অর্থবছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ হাজারে। এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়ে হয় ২ লাখ ৩ হাজার ১৮৯ জন। অর্থাৎ দেড় দশকে নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধির হার ৮২৯ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই বড় সুখবর হলেও নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যার বৃদ্ধির এই প্রবণতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে নির্দিষ্ট কয়েকটা মাত্র ক্ষেত্রে। এসবের মধ্যে রয়েছে বিউটি পার্লার, ব্লক বাটিক ও খাদ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসহ হাতেগোনা কয়েকটি। অন্যসব ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হিসেবে নারীরা অনেক পিছিয়ে থাকছে। নারী উদ্যোক্তারা বলছেন, অর্থনীতিতে তাদের অবদান বাড়াতে হলে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে সুবিধা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে নারীদের জন্য অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পথগুলো সুগম করার পাশাপাশি সেগুলো হাতের নাগালে আনতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নারী উদ্যোক্তা তৈরি করতে পুরুষ ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিদায়ী বছরের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নবম জাতীয় এসএমই পণ্যমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ আহ্বান জানিয়েছিলেন। এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে ঋণ নিয়ে নারীরা যাতে কাজ করার সুযোগ পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
উদ্যোক্তাদের অনেকেই ‘বিশেষায়িত নারী উদ্যোক্তা নগরী’ গড়ে তোলার কথা বলছেন। যে বিশেষায়িত নগরী কেবল নারীর জন্য নারীদের দিয়েই পরিচালিত হতে পারে। নারীই থাকবেন উদ্যোক্তা, নারীই শ্রমিক, নারীই পরিচালক। অনেকটা বিসিক শিল্প নগরীর আদলে তবে সেটা হবে বহুমুখী। যেখানে নারীদের উদ্যোগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপিত হবে। শিল্পের ব্যবস্থাপক, শ্রমিক সবাই হবে নারী। শিল্প কারখানা ছাড়াও এখানে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও থাকবে। যেমন ছোট, বড় শপিংমল, বিউটি পার্লার, হাসপাতাল, জিমনেসিয়ামসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সেবা প্রতিষ্ঠান থাকবে।
গত এক দশকের দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়লেও বর্তমানে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। বিশেষ করে করোনার কারণে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন। করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে উঠতে দাঁড়াতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। তবে তারা বলছেন, নারী উদ্যোক্তাদের বাণিজ্যিক পথগুলো সুগম করতে হবে। রাজশাহীর এমনই এক নারী উদ্যোক্তা নুসরাত জাহান উর্মি অনলাইনে নকশি কাঁথা নিয়ে কাজ করেন। তিনি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য নারীদের জন্য অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পথগুলো সুগম করতে হবে। সেবাগুলোতে হাতের নাগালে আনতে হবে।
নারী উদ্যোক্তা নুসরাত জাহান উর্মি আরো জানান, করোনার কারণে অনেক নারী উদ্যোক্তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোটা বেশ কঠিন। কিছু নারী উদ্যোক্তা এমন তাছে যারা কোনোভাবে ধারদেনা করে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে আগ্রহী করাতে চাইলে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
পার্লার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব রাজশাহীর সভাপতি রুকসানা হুদা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, নারীরা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং পেশা গ্রহণ করছেন। নারীবান্ধব পরিবেশ যতো বেশি হবে ততো নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়বে। নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কেউ কাউকে ছাড়া সফলতা লাভ করতে পারবে না।
উইমেন এন্টারপ্রিনিয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ওয়েব) রাজশাহী শাখার সভাপতি আঞ্জুমান আক্তার লিপি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, নারীরা পিছিয়ে আছে এর পেছনে অনেক কারণ আছে। আমাদের দেশে শিক্ষিত নারীরা প্রথমেই চেষ্টা করে চাকরি করার জন্য। উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা কম করে। একান্তই যারা অর্থিকভাবে সমস্যায় পড়ে তারাই কিছু না কিছু করার চেষ্টা করে। তবে, বর্তমান সময়ে নারীরাও ঘরের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তারাও নিজে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য অনেক নতুন কিছু করছেন।
আনন্দবাজার/শহক