ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বৃহৎশিল্পে বড় ঝুঁকি

জাহাজভাঙা শিল্প

অব্যাহতি পাওয়া বিশ্বের বৃহৎ সব জাহাজের ভাঙন প্রক্রিয়া পরিচালিত হচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল সীতাকুণ্ডে। ফৌজদারহাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে গড়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজভাঙা বা শিপ ব্রেকিং শিল্প। বিগত শতকের ষাটের দশকে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ‘এমডি আলপাইন’ নামের একটি গ্রিক জাহাজ সীতাকুণ্ডে সাগর তীরে আটকে পড়েছিল। তবে বিপর্যস্ত জাহাজটি ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় সেটি ভাঙার কাজ শুরু করে চিটাগং স্টিল হাউজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্য দিয়েই মূলত দেশে প্রথমবারের মতো বিপুল সম্ভাবনাময় জাহাজভাঙা শিল্পের যাত্রা।

তবে ষাটের দশকে যাত্রা করলেও নানা প্রতিকূলতার কারণে বৃহৎ এ শিল্পের বিকাশ ঘটছিল না তেমনভাবে। তবে একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ধীরে ধীরে এ শিল্পে গতি আসতে থাকে। এক পর্যায়ে আশির দশকে এসে জাহাজভাঙা কার্যক্রমটি মোটামুটি শিল্পে রূপ নিতে শুরু করে। বড় বড় উদ্যোক্তারা এ শিল্পে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। বর্তমানে দেশের জাহাজভাঙা শিল্প বিশ্বের শীর্ষ স্থান অর্জন করেছে। পরিণত হয়েছে বড় ও লাভজনক শিল্পে। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে বিশাল অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ইস্পাতের মতো কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এ শিল্প দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে জাহাজভাঙা শিল্পে সরাসরি কর্মরত প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। পরোক্ষভাবে আরো প্রায় ৩০ লাখ এ খাতে জড়িত। আকারের ওপর ভিত্তি করে একটি জাহাজ ভাঙতে নিযুক্ত করতে হয় তিনশ থেকে সহস্রাধিক মানুষকে। এছাড়া আরো বহু মানুষ জাহাজ থেকে সব ধরনের উপকরণ পুনর্ব্যবহারের জন্য কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত থাকে। জাহাজের পুনর্ব্যবহারযোগ্য কিছু সামগ্রী রফতানি করা হয়। বাকিগুলো বিক্রি হয়। যা দেশে পুনরায় ব্যবহার করা হয়। রাজধানীসহ দেশের বহু এলাকায় জাহাজভাঙা শিল্পের উপকরণ বিক্রির ব্যবসায় গড়ে উঠেছে।

তবে বিপুল সম্ভাবনাময় এই শিল্পে আধুনিকায়ন না হওয়ায় নানা সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে মারাত্মক পরিবেশ দূষণকারী শিল্প হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আয়ু ফুরিয়ে এলে একটি বিলাসবহুল জাহাজ নিজেই বিশালবর্জ্যে পরিণত হয়। পরিত্যক্ত জাহাজে অ্যাসবেসটস, ভারী ধাতু, খনিজ তেল, জাহাজের তলা ও ব্যালাস্ট ওয়াটার, পলিসাইক্লিক অ্যারোমাটি হাইড্রোকার্বন, পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল, স্লাজ অয়েল ও অর্গানোটিনসহ বেশ কিছু বিপজ্জনক পদার্থ থাকে। বিপজ্জনক এসব পদার্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা না হলে পরিবেশ ও মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

তবে সদ্যবিদায়ী বছরের ১০ অক্টোবর জাহাজভাঙা শিল্প সর্বোচ্চ পরিবেশ দূষণকারী ‘লাল’ শ্রেণি থেকে তুলনামূলকভাবে কম দূষণকারী ‘কমলা’ শ্রেণির শিল্পে উন্নীত হয়েছে। এই শ্রেণি পরিবর্তনের ফলে এখন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড স্থাপনের আগে পরিবেশগত সমীক্ষা বা ইআইএ করার প্রয়োজন পড়ছে না। তবে গেল কয়েক বছর ধরে জাহাজভাঙা শিল্পে দুর্ঘটনা বেড়েছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর উপকূলজুড়ে গড়ে ওঠা পুরাতন জাহাজ কাটার স্ক্র্যাপ শিপইয়ার্ডগুলো শ্রমিকদের জন্য মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাবে এসব কারখানায় হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। ঘটছে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্বের মতো ঘটনাও।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২১ সালে জাহাজ ভাঙা কারখানায় একাধিক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ১২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ৩০ শ্রমিক। এভাবে গত ৮ বছরে কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় অন্তত ১১০ জন শ্রমিক প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন দুশতাধিক শ্রমিক। যাদের অধিকাংশই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো প্রতিবেদন-

জাহাঙ্গীর আলম, বিশেষ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১৪০টিরও অধিক পুরাতন জাহাজ ভাঙার কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় ১৮ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। পরোক্ষভাবে এই শিল্প সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত হয়ে দেড় থেকে দুই লাখ লোক জীবিকা নির্বাহ করছেন। সম্প্রতি হতাহতসহ দুর্ঘটনার এসব তথ্য জানিয়েছেন জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের কোষাধ্যক্ষ রিজওয়ানুর রহমান খান। তিনি বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী জাহাজ কাটার আগে বর্জ্য, বিষাক্ত গ্যাস ও বিস্ফোরকমুক্ত করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। ভৌগোলিক সুবিধার কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ বড় জাহাজ এখানে ভাঙা হলেও আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় না।

জাহাজ কাটার সময় ট্যাংকার বিস্ফোরণ, জাহাজে আগুন ধরে দুর্ঘটনা ঘটলে আশপাশের লোকজন দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হয়। এছাড়া লোহার ভারী প্লেটের চাপায়, আঘাতে, কালো তেলে পা পিছলে পড়ে, যন্ত্রপাতি ওঠানো-নামানো, বহন, গ্যাসের বিষক্রিয়া, জাহাজের ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া জাহাজের বিভিন্ন রাসায়নিক বিষাক্ত তরল পদার্থের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে কর্মরত শ্রমিকরা ক্যান্সারসহ মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হয়েও মারা যাচ্ছেন। দুর্ঘটনার বাইরে বিষাক্ত উপাদানের কারণে সৃষ্ট অসুখে মারা যাওয়া শ্রমিকদের পরিসংখ্যান পুরোপুরি অজানা।

শ্রম আইনের ৯০(ক) ধারামতে, সেফটি গঠন বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ ইয়ার্ডে এখনও পর্যন্ত তা করা হয়নি। ফলে মৃত্যুঝুঁকির মুখে কাজ করছেন শ্রমিকরা। যার সর্বশেষ শিকার সীতাকুণ্ড উপজেলার শীতলপুরে অবস্থিত যমুনা শিপইয়ার্ডের চার হতভাগা শ্রমিক। বিদায়ী বছরের ২৫ ডিসেম্বর শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনা ঘটে। তার আগে ২৯ সেপ্টেম্বর পুরনো জাহাজভাঙার সময় কাজ করতে গিয়ে মেসার্স খাজা শিপব্রেকিং লিমিটেডে মারা যান তছলিম উদ্দিন (৪০) নামে এক শ্রমিক।

এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর সীতাকুণ্ডের মাদার স্টিল শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে শ্রমিকরা একটি ট্রাক থেকে অক্সিজেনের বোতল নামানোর সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাজিম নামে এক ব্যবসায়ী মাথায় আঘাত লেগে গুরুতর আহত হন। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তির পর মারা যান। এর আগে ১৯ জুন মাদামবিবিরহাট এলাকায় মেসার্স এসএন করপোরেশন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে রিপন চাকমা (২৬) নামে এক শ্রমিক গ্যাস বিস্ফোরণে মারা যান। এ সময় আরও তিনজন গুরুতর আহত হন।

ফোরামের তথ্যমতে, বিদায়ী বছরেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ১২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ৮ বছরে মারা গেছেন ১১০ জন শ্রমিক। মারাত্মক আহত হয়েছেন দুশতাধিক শ্রমিক। যাদের অধিকাংশ স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বছরের পর বছর জাহাজ ভাঙা শিল্প খাতে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু ভয়াবহভাবে বাড়লেও দায়ী মালিক বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

তবে এসব ঘটনার পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল ইয়ার্ডের সেফটিতে নানা ধরনের অসঙ্গতি খুঁজে পেলে সংশ্লিষ্ট ইয়ার্ডগুলোকে জরিমানা ও বিভিন্ন মেয়াদে সব ধরনের স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আবার এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চেয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়কে ২০ নভেম্বর চিঠি দিয়েছে জাহাজ ভাঙা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ)।

চিঠিতে বিএসবিআরএ বলছে, দেশের উন্নয়নে জাহাজ ভাঙা শিল্প বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু অন্য কোনো শিল্প খাতে এ রকম জরিমানা ও আমদানির নিষেধাজ্ঞার মতো ঘটনা ঘটেনি। ফলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত নয়। একই কথা বলেছেন সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট জহিরুল ইসলাম রিঙ্কু। তিনি বলেন, ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন ইয়ার্ড মালিকরা। এ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়লে জাহাজভাঙা শিল্প খাত টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে।

জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক তপন দত্ত বলেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো সুবিধা জাহাজ ভাঙা শ্রমিকরা পাচ্ছেন না। ২০১৮ সালে মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ অনুযায়ী এই সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি মাসিক ১৬ হাজার এবং দৈনিক ৬১৫ টাকা। তবে এ খাতের শ্রমিকরা এখনও দৈনিক মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করে।

মজুরি বোর্ডের রোয়েদাদ কার্যকর করা শ্রম আইনের ১৪৮ ধারা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক হলেও মালিকরা তা মানছেন না। রাতের বেলায় কাজ না করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও মালিকরা তা মানেন না। জাহাজভাঙা শিল্পের মালিকরা এতো বেশি প্রভাবশালী যে, তারা একের পর এক অনিয়ম করে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সাহস সরকারি কর্মকর্তারা দেখাতে পারেন না।

ফোরামের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মালিকরা ব্যবসা এবং মুনাফা বোঝেন। অথচ শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা বোঝেন না। রাষ্ট্র ও মালিকদের এমন নির্লিপ্ততা আর মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে যদি আর একজন শ্রমিকও আহত বা নিহত হন তা দেশের শ্রমিকরা মেনে নেবে না।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন