উত্তর জনপদের নদীগুলো একে একে মরতে শুরু করেছে। তলদেশ ভরে উঠে প্রায় সব নদীই হয়ে পড়েছে পানিশূন্য। অযত্ন আর অবহেলায় নদী মরে যাওয়ায় সুফল তো মিলছেই নয় উল্টো দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলে-দূষণে আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে রংপুর বিভাগের আট জেলায় ছোট বড় মিলে শতাধিক নদী। তিস্তার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাচ্ছে না রংপুর অঞ্চলের মানুষ। তিস্তার ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার বিষয়টির সমাধান হয়নি আজও। তার ওপর নদীভাঙনে প্রতিবছর নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো পরিবার।
উত্তরের শত নদীর সঙ্গে রংপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘাঘট ও মানাস নদী শুধু পানিশূন্যই নয়, হয়ে যাচ্ছে জবরদখল। এক সময়ের খরস্রোতা নদীগুলোর কলকল ধ্বনি আর রং- বেরংয়ের পালতোলা নৌকার সেই দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। তবে নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিচর্যার মাধ্যমে ঘাঘট ও মানাস নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। নদীর গভীরতা আর পানির প্রবাহ বজায় রাখা গেলে এ দুটি নদী বিশাল সম্পদে পরিণত হতে পারে। শীত মৌসুমে উত্তরের নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। উজানের দেশ পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় নদীপাড়ে আগের মতো আর ফসল ফলানো যায় না। এছাড়া নদীগুলোর তলদেশ খনন না করায় পানি ধারণ ক্ষমতা নেই বললেই চলে। অল্প পানিতেই উপচে পড়ে বন্যা কিংবা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে।
সূত্রমতে, উত্তরের শতাধিক নদী রংপুর বিভাগের আট জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে বয়ে গেছে করতোয়া, মহানন্দা, পাম, তালমা, ডাহুক, পেটকি, ছোট যমুনা, বেরং, ঘোড়ামারা, মরা তিস্তা, সুই, চাওয়াই, করুম, গোবরা, ছেতনাই, আলাইকুমারী, টাঙন, আত্রাই, নাগর, বরফা, তীরনই, পাথরাজ, রণচন্ডী, ভেরসা, পাঙ্গা নদী। ঠাকুরগাঁওয়ে রয়েছে টাঙ্গন, নাগর, তিরনই, কুলিক, ঢেপা, সেনুয়া, চরনা, সুক, ভুল্লী, অহনা, লাচ্ছি ও ভক্তি নদী। দিনাজপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীর মধ্যে রয়েছে আত্রাই, করতোয়া, ঢেপা, তুলসি গঙ্গা, মহিলা, চিরি, কাঁকড়া, পূনর্ভবা, ভুল্লী, ছোট যমুনা, গর্ভেশ্বরী, ইছামতি, নলশীসা, তেঁতুলিয়া, ভেলামতি, পাথার ঘাটা, নর্ত, ভেলান ও ছোট ঢেপা। রংপুরের ওপর দিয়ে বইছে তিস্তা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, খোকসা ঘাঘট, আখিরা, ইছামতি, মানাস, ধুম ও আলাইকুমারী নদী।
এছাড়া নীলফামারীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, চারালকাঠা, বুড়িতিস্তা, বুড়িখোলা, খড়খড়িয়া, যমুনেশ্বরী, দেওনাই, ধাইজান, চিকলি, পাঙা এবং শালকি। লালমনিরহাটের নদীগুলো হলো- তিস্তা, ধরলা, সানজিয়ান, গিরিধারী, সতী, ত্রিমোহিনী, মালদহ, রত্নাই, ভেটেশ্বর, ছিনাই, ধলাকাটা, সাঁকোয়া, স্বর্ণামতি। কুড়িগ্রামে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমর, ফুলকুমর, বোয়ালমারী, শিয়ালদহ, জিঞ্জিরাম, সোনাইমুড়ি, কালনদী, গঙ্গাধর, ধরণী, হলহলিয়া, কালকিনি, নীলকমল ও জালশিরা নদী। গাইবান্ধায় বয়ে গেছে বাঙালি, করতোয়া, আলাই, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদী। এছাড়া আরও অনেক নদীর নাম থাকলেও বাস্তবে আজ অস্তিত্ব নেই। অযত্ন-অবহেলায় মরে গেছে সেসব নদী।
ঘাঘট-মানাস শুধুই স্মৃতি:
রংপুরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ঘাঘট ও মানাস। কালের বিবর্তনে জলবায়ুর প্রভাবে মরে যাচ্ছে এ দুটি নদী। নাব্যতা হারিয়ে নদী দু’টি পানিশূন্য হয়ে পড়ায় জবর দখল হয়ে যাচ্ছে। এক সময়ের খরস্রোতা নদীর বুকজুড়ে এখন বিভিন্ন ফসলের আবাদ হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, এক সময় ঘর থেকে বের হয়েই শোনা যেতো নদীর কলকল ধ্বনি। রং-বেরংয়ের পালতোলা নৌকা প্রকৃতিতে যোগ করতো অপরূপ সৌন্দর্য্য। মাঝি-মাল্লার ভাটিয়ালী গানে মুখরিত থাকতো সারাক্ষণ। দিনভর জনসাধারণের পদভারে জমে উঠতো নদীর ঘাটগুলো। এসব এখন শুধুই স্মৃতি। কালের বিবর্তনে মরে গেছে ঘাঘট ও মানাস নদী। নদীর বুক জুড়ে এখন সবুজের সমারোহ। স্থানীয় লোকজন দখল করে নদীর বুকজুড়ে ফসলের আবাদ করছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বেকার হয়ে পড়েছে শত শত মৎস্যজীবি। অভিজ্ঞ লোকজনের ধারণা, নদী দুটি খনন করা হলে মৎস্য চাষসহ আবাদী জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা যাবে। এতে কৃষকরা উপকৃত হবে, সাশ্রয় হবে অনেক টাকা।
নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার কুজিপাড়া গ্রামে তিস্তার শাখা নদী হিসেবে ঘাঘট ও মানাস নদীর উৎপত্তি। ঘাঘট নদী রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার পশ্চিম সীমানা দিয়ে নোহালী, আলমবিদিতর ও বেতগাড়ি ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে রংপুর সদর থানা অতিক্রম করে পীরগাছা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর আলাইকুড়ি নদীকে সঙ্গে নিয়ে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর হয়ে ঘাঘট নদী যমুনায় মিলিত হয়েছে। অন্যদিকে মানাস নদী গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী, গজঘন্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ বন্দরের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পীরগাছা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। এ নদীও আলাইকুড়ি নদীকে সাক্ষাৎ দিয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ভিতর দিয়ে যমুনায় পড়েছে। নদী দু’টির আঁকাবাঁকা পথে ঘাঘট ১২০ কিলোমিটার এবং মানাস নদী ৮৮ কিলোমিটার জুড়ে শুকিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, একসময় এ নদী দুটির উপর দিয়ে পালতোলা নৌকা চলতো। দুর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসতো ব্যবসা করার জন্য। নদীপথে বিভিন্ন প্রকার পণ্য সরবরাহ করতো লোকজন। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে সেই নদীর পানি প্রবাহ থাকে শূন্যের কোঠায়। অথচ বর্ষাকালে নদীর ভাঙনে প্রতিবছর বিলীন হয়ে যায় ঘরবাড়ি।
গঙ্গাচড়ার নদীপারের সচেতন ব্যক্তি আবুল হোসেন ফটিক, মাহাবুবার রহমান তারা ও বদিরুদ্দিন জানান, নদীর নাব্যতা না থাকায় এলাকার লোকজন দখল করে নিয়ে নদীর বুকে চাষাবাদ করছেন। নদী দু’টি খনন করা হলে কৃষকরা উপকৃত হবে বেশি। সেই সঙ্গে বাড়বে মাছের উৎপাদন। তা না হলে স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যাবে ঘাঘট ও মানাস নামের এ নদী দু’টি।
সূত্রমতে, নদীর শিকস্তি ও পয়ন্তি আইন অনুসারে ঘাঘট ও মানাস নদীর বুকে জেগে ওঠা জমিগুলো খাস জমির অন্তর্ভুক্ত। যা স্থানীয় লোকজন জবর দখল করে আবাদ করছে। গজঘণ্টা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম জানান, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সরকার নদী দু’টি খনন করলে কৃষকরা কৃষিকাজে ব্যাপক সুবিধা পাবে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফজলুল হক জানান, উজানে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রবাহ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তিস্তার সঙ্গে এ নদী দু’টির অস্তিত্বও এখন বিলীনের পথে। খননের জন্য ছোট একটি প্রকল্প দেওয়া হয়েছে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। সরকার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে ঘাঘট ও মানাস নদী খনন করলে এলাকার মানুষের অনেক উপকারে আসবে।
পরিচর্যা পেলে ফিরবে আগের রূপে:
ঘাঘট এবং মানাস রংপুর-নীলফামারী, গাইবান্ধার দুটি বড় নদী। এ নদী দুটি নিকট অতীতেও বারোমাসি নদী হিসেবেই ছিল। বর্তমানে যা মৌসুমী নদীতে পরিণত হয়েছে। নদী দুটির প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা চরম পর্যায়ে। মানাস নদীর অবস্থা এখন মৃতপ্রায়। রংপুরের হারাগাছ এলাকায় এর চেহারা বজায় থাকলেও পানি নেই। কাউনিয়া এলাকায় অনেক স্থানে নদীটি সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ সুযোগে স্থানীয় ব্যক্তিরা নদীর বুকজুড়ে ধান চাষ করছে। সেই সুবাদে তারা এ নদীর মালিকানা নিজেদের দাবি করছে। এভাবে নদীটিকে মৃত্যুপথযাত্রীতে পরিণত করা হয়েছে। এখনো এ নদীটির প্রবাহ ফিরিয়ে নদীটিকে বারোমাসি নদীতে পরিণত করা সম্ভব।
অন্যদিকে ঘাঘট নদীর পানি দূষিত করছে রংপুর সিটি করপোরেশন। একে তো অতীত গৌরব হারাচ্ছে নদীটি, তার ওপর সিটি করপোরেশনের দূষণ নদীটির ভবিষ্যৎ খারাপ করে তুলছে। ঘাঘট নদীর শাখা শ্যামাসুন্দরী রংপুর শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। বর্তমানে শহরের সব দূষিত পানি শ্যামাসুন্দরীর মাধ্যমে গিয়ে পড়ে খোকসা ঘাঘট নদীতে। সেখান থেকে ঘাঘট নদীতে পড়ছে সমস্ত দূষিত পানি। এভাবে ঘাঘটের পানি দূষণের শিকার হচ্ছে।
মানাস-ঘাঘট নদীর গভীরতা এবং পানির প্রবাহ বজায় রাখা গেলে এ দুটি নদী বিশাল সম্পদে পরিণত হতে পারে বলে মনে করেন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, মানাস-ঘাঘট দুটি নদী থেকে প্রচুর মাছ পাওয়া সম্ভব। নৌপথ হিসেবে এ নদীর উপযোগিতা আছে। বর্ষায় যখন তিস্তায় পানি বেড়ে যায় তখন এ দুটি নদী তিস্তার প্রচুর পানি বহন করতে পারবে। এভাবে তিস্তার পানির চাপ কমে গেলে ভাঙনও কমবে। মানাস এবং ঘাঘটকে বাঁচাতে হলে সবার আগে তিস্তার যে যে স্থান থেকে এ নদী দুটির উৎপত্তি সেই উৎসমুখ উন্মুক্ত রাখতে হবে। একই সঙ্গে তিস্তার পানির নিশ্চয়তারও বিধান করতে হবে।