ঢাকা | বৃহস্পতিবার
১৬ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
২রা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উত্তাল একাত্তরের অশান্ত প্রহরগুলি

উত্তাল একাত্তরের অশান্ত প্রহরগুলি

৭ই মার্চ সকালে রেসর্কোসের মাঠে শেখ মুজিবের বক্তৃতা মানুষকে চুম্বকের মতো উদ্বুদ্ধ করলো। মানুষ দলে দলে অস্ত্রবিহীন যুদ্ধ মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক আহ্বানে, অনুপ্রেরণায় যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়লো।

সাদা পোশাকে বিমানে করে প্রচুর সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে আসছে। চট্রগ্রামে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ এসে ভিড়েছে। বাঙালিরা মরণ-পণ রাস্তায় ব্যারিকেট দিচ্ছে। জাহাজ খালাস করতে দিবে না। শুরু হয়ে গেছে মরণপণ যুদ্ধ। পাগলের মতো পাকিস্তানি সেনারা মানুষ মারছে। বস্তি, বাজার, বাড়ি-ঘর জ্বালাচ্ছে। ভারী ভারী কামানের গোলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উড়িয়ে দিচ্ছে। অনিশ্চিত ভয়ে ভয়ঙ্কর বিভিষিকা থেকে বাঁচার তাগিদে মানুষ দিগ্বিদিক, ছুটছে। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে। তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। টহলদার মিলিটারিরা তরুণ ছেলেদের দেখলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দু’তিনজন/ চারজন মানুষ এক সঙ্গে জড়ো দেখলেই নিষ্ঠুরভাবে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে টর্চার করছে।

২৫শে মার্চের রাত থেকে এমন দুর্বিষহ বিভীষিকা নেমে এসেছে মানুষের ওপর। ফট্ফট্ গুলির বৃষ্টি দুমদুম বুটের আওয়াজ ভয়ার্ত রাত্রি..। রাস্তায় যত্রতত্র রক্তাক্ত লাশ বিচ্ছিন্ন পড়ে আছে..। খবর শুনে আমরা সবাই স্তব্ধ বিমুড় হয়ে গেলাম। বৃষ্টিও পড়ছে। অন্ধকার রাত দুর্যোগের মেঘ যেন ঘন হয়ে আসছে। রৌফদা, রঞ্জুদা আজ সারাদিন বাসায় ফেরেনি। দুঃশ্চিন্তার পাহাড় ভেঙে আসল বাবা-মা সবার মাথায়। আব্বা সকালেই বেরিয়ে গেলেন বাজারের দিকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তাণ্ডব ধ্বংসলীলায় সারাদেশ আতংকে কাঁপছে। দুপুর ১২টার দিকে দাদি আমাদের বাসায় এলেন। কাদামাটি উপেক্ষা করে ক্ষেতের আইল দিয়ে হেঁটে চলে এসেছেন। বারান্দায় বসে পড়লেন আমাদের সঙ্গে। সবাই স্তব্ধ।

কী হচ্ছে, কী হবে এখন। দুলাদার (বড় ভাই) ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। রিজুদা ফোনে জানাল, গত লাস্ট ফ্লাইটে বড় ভাই ভাবিসহ লন্ডনে চলে গেছেন। বাড়িতে যোগাযোগ সম্ভব হয় নাই। আব্বা আরও একটা ধাক্কা পেলেন। দাদি আব্বাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন, দেশের এরকম অবস্থায় দেশের বাইরে চলে গেছে ভালোই হয়েছে। আর ক’টা দিন দেরি হলে তো যেতেই পারতো না। আকাশ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রৌফদা, রঞ্জুদা বাসায় ফিরেনি দু’দিন হলো। আব্বা খবর পাবার জন্য ছটফট ছুটাছুটি করছেন। যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন বিভিন্ন জায়গায়। সন্ধার পর প্রতিবেশী কমলা ফুফু বাসায় এলেন। আম্মার পাশে বসে নিচুস্বরে বললেন, ধীরাজ চাচা (ফুফুর ভাই), রৌফ, রঞ্জু পাড়ার কিছু ছেলে গত রাতে বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে গেছেন। ওরা বলে গেছে বাড়ির সবাই মিলে সীমান্তের কাছাকাছি গ্রামে চলে যেতে। কারণ সৈয়দপুরে ক্যাম্প হলে এখানে থাকা নিরাপদ হবে না। নিচু স্বরে কথা বলছেন দেখে আব্বাও কাছে এসে শুনলেন সবকিছু। আব্বার মুখের দিকে তাঁকিয়ে হাত-পা হিম হয়ে আসছে।

জুন মাস আকাশে হেলিকপ্টার ঘুরছে। বাইরে থেকে বাসায় ফিরে আব্বা বললেন ট্রেন্স খুঁড়তে হবে। যে কোনো মুহূর্তে বোমা নিক্ষেপ হতে পারে। তুতুল, পুতুল, নিনাও ছুটে এসে বলল, সৈয়দপুরে আর্মি ক্যাম্প করেছে। বড় বড় ট্যাঙ্ক এসেছে। বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দু-তিনজন একসঙ্গে দেখলে গুলি চালাচ্ছে। হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে। ঘরে ঘরে সবাই গর্ত খুঁড়ে লুকানোর জায়গা করছে। রাতে অন্ধকারে ট্রেন্সের ভিতর শুকনা খাবার নিয়ে স্বাধীন বাংলার খবর শোনার কি আকুল প্রতীক্ষা..। খুব মন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনি..। ‘চরমপত্র’ কিছুটা আশা জাগায় উত্তেজনা জাগায়। বুক ভেঙে আসে..। শরীর হিম হয় অনিশ্চিত প্রহর …। নির্ঘুম রাত এভাবেই ভোর হয়..। জানি না আবার কী খবর হবে।

চাচাদের ছেলেরাও মুক্তিযুদ্ধে গেছে। পাড়ায় কোনো তরুণ ছেলে নাই। দাদী আমাদের বাসায় আছেন। দিনের পুরোটা সময় জায়নামাজেই দোয়া দরুদ, ওজিফা নিয়ে পড়ে থাকেন। বৃষ্টির জন্য পাক আর্মিরা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা শত কষ্টেও দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের কাজ ঠিকই করে যাচ্ছে। (চলবে)

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন