বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগর ঘিরে বিশ্ব শক্তিগুলোর আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর দৃষ্টি এখন বঙ্গোপসাগরের দিকে। এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির স্বার্থে সংযুক্তির অবকাঠামোতে অর্থায়নের পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিশেষ জোর দিচ্ছে সুপারপাওয়ার দেশগুলো। এতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিশ্বের ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলকারী বাংলাদেশের সমুদ্রপথ। বিশ্বের অর্ধেক পণ্য ও জ্বালানিবাহী জাহাজ আমাদের সমুদ্রপথ ব্যবহার করছে। বছরে চলাচল করছে প্রায় ৪০ হাজার জাহাজ।
ভারত ও মিয়ানমার বাদে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন হয় বঙ্গোপসাগর পথে। এছাড়াও বিপুল মৎস্য সম্পদসহ নানা প্রকার সামুদ্রিক সম্পদের ভাণ্ডারও এই সাগর। যা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্রমশ আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। আগামী দিনে এই সাগরই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির নিয়ামক।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বঙ্গোপসাগরের সামগ্রিক আয়তন প্রায় ২২ লাখ বর্গকিলোমিটার। শ্রীলঙ্কার উপকূলবর্তী এলাকা থেকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বাঁক ঘুরে এর বিস্তার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মানচিত্র বরাবর দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়া উত্তরে সুমাত্রা অবধি। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ লোক বাস করছে এ সাগর ঘিরে থাকা দেশগুলোতে। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভুটান ও ভারতের নানামুখী বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড এই সাগর ঘিরে। বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক বিস্তৃতি এমনই যে, যেকোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশ পশ্চিম মিয়ানমার ও চীনের ইউয়ান প্রদেশ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবেই বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব অপরিসীম। ভূ-রাজনীতির কারণে বিগত শতকের আশির দশক থেকে এর গুরুত্ব আরো বেড়েছে। এই ভূ-রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বাংলাদেশকে। বর্তমান সরকার সংঘাত এড়িয়ে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার নীতি অনুসরণ করছে। আর ভারসাম্যের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের (আইপিএস) পাশাপাশি চীনের নেতৃত্বে বেল্ট অ্যান্ড রোডের (বিআরআই) সক্রিয় অংশীদার এখন বাংলাদেশ।
ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের মোট তেল ও গ্যাস মজুতের এক শতাংশ (প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট) লুকিয়ে আছে ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উপকূল বরাবর সাগরের তলদেশে। এ কারণে নিজেদের আধিপত্য সৃষ্টি করতে বা ধরে রাখতে একদম শুরু থেকে বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন নিয়ে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নামে চীন, জাপান ও ভারত।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা যেখানে এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার, সেখানে দেশের সব নদ-নদী-হাওর যোগ করলে দৈর্ঘ দাঁড়ায় ১৫ হাজার কিলোমিটার। সমুদ্রপথে আমাদের বছরে বাণিজ্য প্রায় ৯ হাজার কোটি ডলারের। বিদেশি সাড়ে চার হাজার জাহাজ বাংলাদেশে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহন করে। আর এসব জাহাজ ভাড়া বাবদ প্রতি বছর দেশে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের গভীর দৃষ্টি এবং প্রভাব থাকলেও ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমান্ত নৈকট্যের কারণে ভারত এবং চীনের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাটা বেশিই দৃশ্যমান। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোয় নৌবাহিনীর অস্ত্রসম্ভার রফতানি নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে এক ধরনের রশি টানাটানির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই চীনের সঙ্গে এক জটিল সম্পর্ক বজায় রেখেছে মিয়ানমার। কূটনৈতিক সম্পর্কে কখনো কখনো টানাপোড়েন দেখা দিলেও সেখানে সামরিক ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বিদ্যমান। বলা চলে চীনের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের দিক দিয়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতা মিয়ানমারের রয়েছে।
সমুদ্রপথে চীন ক্রমান্বয়ে অধিকতর ক্ষমতাশালী ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে। দক্ষিণ চীন সাগরে দেশটি সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন করছে। চীনের কোস্টগার্ড নিয়মিতভাবেই জাপানের সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন করছে। চীনের এই আধিপত্য রোধ করতেই যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-অস্ট্রেলিয়া-ভারত কোয়ার্ড গঠন করেছে। ভূ-রাজনীতি নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার।
মার্কিন নৌকৌশলবিদ আলফ্রেড থায়ার মাহান তার ‘দ্য ইন্টারেস্ট অব আমেরিকা ইন সি পাওয়ার’ (১৮৯৭) শিরোনামের বইয়ে লিখেছেন, সমুদ্রবাণিজ্য বা নৌশক্তি যেভাবেই হোক, সমুদ্র যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তার পক্ষে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তার যুক্তি হচ্ছে, স্থলভূমিতে যতই সম্পদ থাকুক না কেন, সমুদ্রপথে সম্পদ বিনিময় বা বাণিজ্য যত সহজ, অন্য কোনো পথে অত সহজ নয়।
বর্তমান পৃথিবীতে বিশ্ববাণিজ্যের ৯০ ভাগই হয় সমুদ্রপথে এবং সমুদ্র যোগাযোগব্যবস্থার ওপর কার্যত একক নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ছড়ি ঘুরিয়ে যেতে পারছে। এখন চীন, রাশিয়া এবং ভারতের মতো দেশগুলোও একই নীতিতে তাদের চারপাশের সমুদ্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তৎপর। তার ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এসব শক্তির সহযোগিতার যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিরোধের আশঙ্কা রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে ওঠার চলমান প্রক্রিয়াটি অব্যাহত থাকবে আগামীদিনেও। সেক্ষেত্রে সংঘাতের চেয়ে সহযোগিতার পথ ধরে হাঁটলেই সব পক্ষ অধিকতর উপকৃত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি, বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থ কাজে লাগিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করায় উদ্যোগী হতে পারবে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী ক্ষুদ্র দেশ ও জাতিগুলো।
আনন্দবাজার/শহক