ঢাকা | রবিবার
২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কৃষিজমিতে বাড়ছে মৎসখামার

কৃষিজমিতে বাড়ছে মৎসখামার

দেশে কৃষি জমি নষ্ট না করার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও দেশের বহু এলাকায় ফসলি জমি খনন করে মৎসখামার তৈরির প্রবণতা বাড়ছে। ফসল চাষে ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি মুনাফা কম পাওয়ার কারণে ফসলি জমির বিকল্প ব্যবহার বাড়ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা রাজশাহীতে দিন দিনই কমে আসছে কৃষিজমির পরিমাণ। পাশাপাশি বেড়ে যাচ্ছে মৎসখামারের সংখ্যা। মৎসচাষে মুনাফা বেশি হওয়ায় কৃষি ও বহু ফসলি জমি খুড়ে তৈরি করা হচ্ছে পুকুর ও জলাশয়। সেখানে চাষ করা হচ্ছে মাছ।

সূত্রমতে, ২০১৭ সালে জেলায় মোট জলাশয়ের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ২৯৪ হেক্টর। সেখানে বাণিজ্যিক মাছের খামার ছিল ৩ হাজার ৪৬২ হেক্টর। ২০১৮ সালে বাণিজ্যিক খামারের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৩০৯ হেক্টর। বাণিজ্যিক খামার বৃদ্ধির সেই হিসেবে রাজশাহীতে পুকুরের মধ্যে প্রবেশ করেছে ৮ হাজার ৮৬৭ হেক্টর জমিতে। এ হিসেব তো ২০১৮ সালের। সেই থেকে পুকুর খনন চলছেই। এমন কি করোনার মধ্যেই থেমে ছিল না পুকুর খনন। দানব এস্কেভেটর মেশিন থাবা বসিয়েই চলেছে কৃষি জমিতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলায় পুকুর খননের জন্য প্রায় ১০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি নষ্ট হয়েছে। আবাদি জমি খনন করে পুকুর তৈরির কারণে কমছে খাদ্যশস্য উৎপাদন। হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। অধিক লাভের আশায় মাছ চাষ করে একশ্রেণির প্রভাবশালীরা খনন করেছে এসব। এতে কমেছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। পানি নিষ্কাশন নালা, এমনকি ব্রিজ-কালভার্টের মুখেও অপরিকল্পিত পুকুর খনন করা হয়েছে।

সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু ফসল নষ্টই নয়, পুকুর খনন বেশি হওয়ায় গ্রামে গৃহপালিত প্রাণিও কমে যাচ্ছে। চারণভূমি সংকটে হচ্ছে। ধান ও পাট, পানের বরজ, মরিচ, শাকসবজির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকরা। জেলায় এখন বাণিজ্যিক মাছের খামার রয়েছে ৪৩ হাজার ১৯৬টি। তবে মাছ চাষের জন্য কি পরিমাণ আবাদি জমি কমছে সেই তথ্য নেই মৎস্য দপ্তরে। তবে অপরিকল্পিত পুকুর খননের ফলে মাছের চাষ বাড়ছে।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রমতে, জেলায় মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর। এক শতাংশও আবাদযোগ্য পতিত জমি নেই। ২০০৭-২০০৮ সালেও জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৯১ হাজার ৭৮০ হেক্টর। ২০১২-২০১৩ মেয়াদে তা গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৯০ হাজার ৮১০ হেক্টরে। এখন আবাদযোগ্য জমি রয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। এক দশকে আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৩ হাজার হেক্টরের উপরে। এর একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে। জেলায় পুকুর খননের হিড়িক পড়েছে ২০১৩ সালের পর থেকে। এরপর থেকে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে পুকুর খনন। কমছে জেলার কৃষি জমি।

রাজশাহীর পবায় আদাজল খেয়ে অপরিকল্পিত পুকুর খনন শুরু করেছে এক শ্রেণির মুনাফা লোভী। উপজেলার বাগধানি ও তেতুলিয়া মৌজায় ২০০ বিঘার বেশি কৃষি জমিতে দিনরাত চলছে এ খননের কাজ। অভিযোগ উঠেছে এ কাজে প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে চলেছে প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও থানা পুলিশ। প্রেক্ষিতে পুকুর খনন বন্ধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কিছু অসাধু ব্যক্তি আবাদি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করছে। দেদারসে চলছে খননযজ্ঞ। কমছে কৃষি জমি, বাড়ছে কৃষি শ্রমিকের বেকারত্ম। ভেঙে পড়ছে গ্রামীণ নিরাপত্তা বেষ্ঠনী।

আবাদের ফাঁকে ফাঁকে গরু ছাগল পালনের তৃণভূমি থাকছে না। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ার শংকা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি অপরিকল্পিত পুকুর খননে বিলগুলোর পানি নিষ্কাশনে সমস্যা এবং শতশত বিঘা জমি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে অনাবাদি রয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পুকুরকাটা বন্ধে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সহায়তা কামনা করেছেন।

গত একবছরে রাজশাহী জেলায় বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। মাছের উৎপাদন বাড়ায় একে সাফল্য হিসেবে দেখছে মৎস্য দপ্তর। তবে কৃষি দপ্তর বলছে, বাণিজ্যিক এসব পুকুর খনন হয়েছে অবাদি জমিতেই। অপপরিকল্পিত পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। পরিবেশের উপর বাড়ছে চাপ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি বিভিন্ন কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোতে অনাবাদি কিংবা এক ফসলি দেখিয়ে পুকুর খনন করছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুকুর-দীঘি খনন করতে পূর্বানুমতি লাগে না এমন তথ্যের ভিত্তিতে মুনাফালোভীরা সেই সুযোগটিই নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

মৎস্য খামারিরা সাধারণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জমি বছর মেয়াদি লিজ নিচ্ছেন কাউকে জমি বিক্রি করতে বাধ্যও করছেন। তাছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে চাষাবাদ না হওয়ায় চাষিরাও জমি লিজ অথবা বিক্রি করছেন। পুকুর খনন করে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা রাখছেন না খামারিরা। ফলে বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। এলাকার সচেতনমহল, পরিবেশবাদি ও ভুক্তভোগিরা জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের মদদেই চলছে এই পুকুর খনননের মহোৎসব। পানি নিস্কাশনের ক্যানেল না রাখায় কৃষিজীবিদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। রাজশাহী জেলায় দিন দিন বেড়েই চলেছে বাণিজ্যিকভাবে মাছের খামার। কৃষিজমি লিজ নিয়ে এসব খামারের নামে চলছে মাটি বিক্রির মহোৎসব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পবা উপজেলার বিভিন্ন মাঠে জোরেশোরে চলছে পুকুরখননের কাজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগি বলেন, বাগধানি, তেতুঁলিয়া ও তালুকধরমপুর মাঠে কমপক্ষে ৩০টি এস্কেভেটর গাড়ি দিয়ে রাত দিন পুকুরখননের কাজ চলছে। এমন চিত্র শুধু পবা উপজেলারই নয়। রাজশাহীর অন্যসব উপজেলাগুলোতেই একই অবস্থা বিরাজ করছে।

পবা উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি শেখ এহসান উদ্দীন বলেন, অভিযান হচ্ছে না বিষয়টি সঠিক নয়। পারিলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বড়ভালাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে স্বপন ও রফিকের পুকুরখনন কাজ বন্ধ করা হয়েছে। প্রশাসন এ ব্যাপারে কার্যকরি পদক্ষেপ নিচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন