- ১৯৮১ সালে বাজার ১৭৩ কোটি টাকার
- ২০২০ সালে এসে ২৬১৩৮ কোটির
- ১৬০ দেশে রফতানি ১৫০০ কোটি টাকার ওষুধ
- চাহিদার ৯৮ ভাগ উৎপাদন, কর্মসংস্থান দুই লাখ
দেশের দ্রুত বিকাশমান শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম ওষুধশিল্প খাত। একটা সময় দেশীয় চাহিদার ৮০ ভাগই আমদানি করা হতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। ওষুধ উৎপাদন করে জনগণের চাহিদা মেটানো ছিলো তখন কল্পনাতীত। অথচ গেল কয়েক দশকে এ শিল্প খাত বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তৈরি পোশাক শিল্প খাতের পরই ওষুধ শিল্পকে দেখা হচ্ছে অন্যতম প্রধান রফতানিপণ্য হিসেবে। তাছাড়া রফতানি আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম খাতও এখন ওষুধ শিল্প। পরিমাণ ও গুণগত মানে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাড়িয়ে চলেছে দেশের সুনাম। মানুষের পাশাপাশি কৃষিখাতের জন্য ওষুধ বা কীটনাকশক তৈরিতেও সক্ষমতা অর্জন করেছে এ খাত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য উন্নতমানের চিকিৎসক ও চিকিৎসাসামগ্রীর পাশাপাশি প্রয়োজন মানসম্পন্ন ওষুধ। তারা দেশের ওষুধ শিল্পকে আরও দায়িত্বশীল হয়ে ওষুধের উৎপাদন ও মান-নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত ভালো উৎপাদন অনুশীলন (জিএমপি) নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ওষুধ আমদানি করে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো হতো। তবে এখন চাহিদার ৯৮ ভাগই পূরণ করা হচ্ছে দেশীয় শিল্পে উৎপাদিত ওষুধে। শুধু তাই নয়, দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও হচ্ছে বিশ্বের ১৬০টিরও বেশি দেশে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। রফতানি প্রতিবছর দেড় হাজার কোটি টাকার।
বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ওষুধ রফতানি থেকে আয় হয়েছে ১৩৬ মিলিয়ন ডলার বা ১৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছে ৩ কোটি ৩২ লাখ ৩০ হাজার ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। এ অর্থবছরে শুধু করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার করা ওষুধ রফতানি করে আয় হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, এছাড়া বৈশ্বিক ওষুধ রফতানিতে বিশ্বের ১৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। অ্যালোপ্যাথিক ছাড়াও তৈরি করা হচ্ছে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধ। বর্তমানে দেশের প্রায় ২৫৭টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি রয়েছে যারা প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয়ী বা জেনেরিক ওষুধ তৈরি করছে। গেল পাঁচ বছরে ওষুধ শিল্পে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালে ওষুধের দেশীয় বাজারের আকার ছিল প্রায় ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারের। যা ২০১৯ সালে বেড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
রিসার্চ এন্ড মার্কেট নামের প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওষুধের বাজারের আকার আগামীতে ১১৪ শতাংশ বেড়ে যাবে। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ তা গিয়ে দাঁড়াবে ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বর্তমানে বিশ্ব বাজারের প্রায় ১০ শতাংশ দখলের চেষ্টা করছে দেশীয় ওষুধ শিল্পখাত। ইতোমধ্যে দেশের ৬টি দেশীয় কোম্পানি উন্নত দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ডাব্লিউটিও এবং ডাব্লিউআইটিও-এর মতো বিশ্বসেরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে জিএমপি সনদ পেয়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের (ডিজিডিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অনুন্নত ৪৮টি দেশের মধ্যে ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। মোট ২৭৪টি নিবন্ধিত ওষুধ কারখানার মধ্যে চালু রয়েছে ২১৪টি। যা থেকে দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধ ও কাঁচামাল উৎপাদিত হচ্ছে। এই শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দু’লাখ মানুষের। বর্তমানে দেশের মোট ওষুধের বাজারের ৯০ শতাংশই স্থানীয় কোম্পানির। বাকি ১০ শতাংশ মাত্র বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অধীনে। উৎপাদিত ওষুধের প্রায় ৮০ শতাংশই সাশ্রয় বা জেনেরিক। বাকি ২০ শতাংশ পেটেন্ট। জিডিপির প্রায় এক দশমিক ৮৩ শতাংশ আসছে ওষুধ শিল্পখাত থেকে। জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ওষুধ রফতানিকারক দেশ।
সূত্রমতে, স্বাধীনতার আগে দেশীয় ওষুধ কোম্পানি ছিল মাত্র দুটি। ১৯৭২ সালে ওষুধের বাজার ছিল ১০০ কোটি টাকার কম। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিল আমদানি করা ওষুধ। ২০১২ সালে ওষুধের বাজার ছিল ৯ হাজার কোটি টাকার। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকায়। ২০১৪ সালে ওষুধ রফতানিখাতে আয় ছিল ৬৯ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ছয় বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে এ আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। অ্যালোপ্যাথি ওষুধ কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি করে। এ ছাড়া ১২ হাজারের বেশি ধরনের আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হারবাল ওষুধ তৈরি হচ্ছে।
ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য কৃতিস্বত্ব পেতে বিগত ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে ট্রিপস চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পেটেন্ট ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সুবিধা পেয়েছে। এতে কম খরচে ওষুধ উৎপাদন করায় ভোক্তা পর্যায়ে ওষুধের দাম অনেক কমে আসে। যা বাংলাদেশের মতো অনুন্নত স্বাস্থ্য খাতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রাথমিকভাবে চুক্তিটি ২০০৫ সাল পর্যন্ত বৈধ ছিল। পরে ২০৩৩ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এতে দেশের ওষুধ শিল্পের উন্নয়নকে আরো গতিশীল করেছে।
দেশে মূলত, ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের গতি শুরু হয়েছিল আশির দশক থেকে। ১৯৮১ সালে দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ওষুধ কারখানার সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬৬টি। ওষুধ উৎপাদনে সে সময় গ্ল্যাক্সো, ফাইজারের মতো ৮টি বহুজাতিক কোম্পানির দাপট ছিল। কারণ তারাই দেশের ওষুধের চাহিদার ৭৫ ভাগ সরবরাহ করতো। তখন ২৫টি মাঝারি আকারের দেশীয় ওষুধ কোম্পানি মাত্র ১৫ ভাগ আর ১৩৩টি কোম্পানি অবশিষ্ট ১০ ভাগ ওষুধ উত্পাদন করেছিল। তবে ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতির অনুসরণে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হলে সব ধরনের ওষুধের স্থানীয় উৎপাদন ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। অতিজরুরি ওষুধের সরবরাহ বেড়ে যায়। মানহীন ওষুধ তৈরির প্রবণতাও কমে আসে।
সূত্রমতে, সেই ১৯৮১ সালে তৈরি ওষুধের স্থানীয় বাজার ছিল মাত্র ১৭৩ কোটি টাকার। চলতি শতকের ২০০২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১০ কোটি টাকায়। এরপর ২০১২ সালে এসে এক লাফে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকায়। বছর পাঁচেক পর ২০১৭ সালে আকার হয় ১৮ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ২১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ২৩ হাজার ১৮৪ কোটি এবং ২০২০ সালে ২৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা।
বিশ্ববাজারে দেশীয় ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে কিছু আইনি ও নীতিগত বাধা থেকে গেছে। সেসব বাধা দূর করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও ওষুধশিল্পের প্রধান সমস্যা কাঁচামাল। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এ সমস্যা সমাধানেও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। কাঁচামাল তৈরির জন্য মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় একটি অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট (এপিআই) পার্ক তৈরি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অনেকে কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। এখানে কাঁচামাল উৎপাদন শুরু হলে দেশের ওষুধশিল্প আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওষুধ সমিতির দেয়া তথ্যমতে, সারাদেশে অবৈধ দোকানের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষাধিক। রাজধানীর মিটফোর্ড পাইকারি ব্যবসায়ীদের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর চোরাচালানের মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি বিদেশি ওষুধ দেশে আসে। চোরাচালান ও নকল ওষুধ রোধ করা গেলে দেশীয় ওষুধের বাজার চাহিদা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
আনন্দবাজার/শহক