ঢাকা | বৃহস্পতিবার
৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পোড়াবাড়ির চমচমে মজবুত অর্থনীতি

পোড়াবাড়ির চমচমে মজবুত অর্থনীতি

পোড়াবাড়ির চমচম। নাম শুনলেই জিভে পানি এসে যায়। অতুলীয় স্বাদ ও গন্ধে দেশজুড়ে সুখ্যাতি রয়েছে টাঙ্গাইল পোড়াবাড়ির এ চমচমের। পোড়া ইটের রঙের এ বিখ্যাত সুস্বাদু চমচমের কড়া মিষ্টির আবরণের মধ্যে রয়েছে গোলাপী আভাযুক্ত নরম অংশ। মিষ্টি জগতে ঐতিহ্যবাহী এ চমচম বৃটিশ আমল থেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাঙ্গাইলকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করেছে। আঞ্চলিক প্রবাদ রয়েছে চমচম-টমটম, গজারির বন, টাঙ্গাইলের শাড়ি তার গর্বেও ধন। জনশ্রæতি রয়েছে গৌড় নামের এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম পোড়াবাড়িতে এ সুস্বাধু চমচম তৈরী ও ব্যবসা শুরু করেন। প্রসিদ্ধ এ চমচম শুধু টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যই ধরে রাখেনি, অসংখ্য পরিবারকে করেছে স্বাবলম্বী। এ পেশার সাথে সম্পৃক্তদেরকে অর্থনৈতিকভাবে মজবুত করছে। দুধ থেকে চমচম তৈরি, বিক্রিতে মালিক-কারিগরসহ কয়েকশ’ পরিবার অর্থনৈতিকভাবে মজবুত হয়েছে। শুধু টাঙ্গাইল নয়, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও যায় এ প্রসিদ্ধ চমচম।

পোড়াবাড়ির চমচম তৈরির প্রধান উপকরণ দুধের ছানা, ময়দা আর চিনি। এ সব উপকরণে তৈরি চমচমে নরম ভাব যেমন, তেমন ঘ্রাণেও অনন্য। লালচে রঙের পোড়াবাড়ির চমচমের ওপর দুধ জ্বাল করে শুকিয়ে তৈরি গুঁড়া মাওয়া ছিটিয়ে দেওয়া হয়। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এ বিশেষ মিষ্টি আজও ধরে রেখেছে প্রায় দুশো বছরের ঐতিহ্য। যে কারণে পোড়াবাড়ির চমচম এতো প্রসিদ্ধ, মিষ্টিপ্রেমী মানুষের কাছে তা জানার আগ্রহ সবসময়। জেলা শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে পোড়াবাড়ি নামক স্থানে একসময় লঞ্চঘাট ছিল। বৃটিশ আমলে ধলেশ্বরী নদীর ঢালান ঘাটে ভিড়তো স্টিমার আর মালবাহী জাহাজ। ওই সময় দেশ বিদেশের মানুষ নামতেন পোড়াবাড়িতে। মানুষের আগমনে পোড়াবাড়ি ছিল জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র। তখন আসাম থেকে আগত দশরথ গৌর ধলেশ্বরীর সুস্বাদু পানি ও এখানকার গাড় দুধ দিয়ে প্রথম চমচম নামের এ মিষ্টি তৈরী করেন। চমচমের স্বাদ মূলতঃ পানির উপর নির্ভরশীল। পানির মধ্যেই পোড়াবাড়ি মিষ্টি তৈরীর মূল রহস্য।

বাংলাদেশের অনেক জায়গায় টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি থেকে কারিগর নিয়ে চমচম তৈরীর চেষ্টা করেও কেউ সফল হতে পারেনি। অপূর্ব স্বাদের এ চমচম সারা ভারতবর্ষে সুখ্যাতি লাভ করে। পূর্বে লঞ্চ, স্টিমারে করে পোড়াবাড়ির চমচম ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে যত। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ মণ চমচম তৈরী করা হতো বিভিন্ন চমচম কারখানায়। যমুনার কোলে প্রবল স্রোতস্বিনী ধলেশ্বরী নদীর সুস্বাদু পানি, গাভীর ঘন দুধ ও কারিগরদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় পোড়াবাড়ির চমচম ‘মিষ্টির রাজা’ হিসেবে সুনাম অর্জন করে। ব্যাপক সাফল্যের কারণে তখন পোড়াবাড়িতে ৩৫ থেকে ৪০টি চমচম তৈরীর দোকান গড়ে উঠে। চমচম তৈরীর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রায় ২ শতাধিক পরিবার। চমচমের স্রষ্টা দশরথ গৌরের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে রাজারাম গৌড়, নারায়ণ হালুই, মোদন গৌড়, শিব শংকর ও কুশাই দেবের নাম উল্লেখযোগ্য।

জানা যায়, উনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিক থেকেই পোড়াবাড়িতে প্রথম চমচম তৈরী শুরু হয়। এ সময় দুধ ছিল খুবই সস্তা। দুধের কোন মাপ ছিল না। এক ঘটি দুধের দাম ছিল তিন পয়সা থেকে পাঁচ পয়সা। প্রতি সের চমচম বিক্রি হতো সাত আনা থেকে আট আনায়। চল্লিশের দশকে চমচম বিক্রি হতো ১টাকা সের। বর্তমানে ১৪০ থেকে ২৫০ টাকায় এক কেজি মিষ্টি বিক্রি করে লাভ হয় ১০ থেকে ১২ টাকা। আর তখন এক সের চমচম ৫ সিকিতে বিক্রি করে আট আনা মুনাফা হতো। বহু দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা পোড়াবাড়ির চমচমের ভক্ত ছিলেন। এর মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, যাদু সম্রাট পিসি সরকার, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম উল্লেখযোগ্য। জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, নবাব আলী চৌধুরী, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, প্রমথ নাথ চৌধুরীসহ অনেক ব্যক্তিত্বের পদচারণ হয় পোড়াবাড়িতে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পোড়াবাড়ি মদন লালের মিষ্টি ঘরে বসতেন। চমচম নিয়ে আপ্যায়ন করতেন রাজনৈতিক শিষ্য ও ভক্তদের। ত্রিশ দশকের শেষের দিকে আসামের রামেন্দ্র ঠাকুর, তীর্থবাসী ঠাকুর টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারে মিষ্টি তৈরীসহ ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকে পাঁচআনী বাজার মিষ্টিপট্রি নামে পরিচিতি হয়ে আছে।

১৯৬০ সালের পর টাঙ্গাইল মহকুমার টাঙ্গাইল সদরে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। এ সময় ধলেশ্বরীর বুকে জেগে উঠে অসংখ্য চর। যে ধলেশ্বরী তার বুকের যৌবন সুধা ফেলে দিয়েছিল চমচমের উপর, পরবর্তীতে গুটিয়ে নেয় তার ব্যাপ্তি। বন্ধ হয়ে যায় পোড়াবাড়ির লঞ্চ ও স্টিমার ঘাট। জনবহুল পোড়াবাড়ি এক সময় জনশুন্যে হয়ে যায়। কারিগর-শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েন। পরে তারা অন্য পেশায় চলে যায়। বর্তমানে পোড়াবাড়ির অবস্থা করুণ। নানা সমস্যায় জর্জরিত ছোট একটি বাজারে মাত্র ৪ থেকে ৫টি জরাজীর্ণ মিষ্টির দোকান ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বাজারের আশেপাশের ৬ থেকে ৭টি বাড়িতে এখনো মিষ্টি তৈরী হয় এবং তারা ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে। এছাড়াও শহরের পাঁচআনী বাজারে কয়েকজন মিষ্টি ব্যবসায়ী ঢাকার শতাধিক দোকানসহ প্রায় দেশের ৫ শতাধিক মিষ্টি ব্যবসায়ীদের এ মিষ্টি সরবরাহ করে থাকে।

অপরদিকে কিছু কিছু অসাধু মিষ্টি ব্যবসায়ী টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের নাম করে বড় বড় সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে ঢাকাসহ কয়েকটি জায়গায় মিষ্টির দোকান গড়ে তুলেছে। এসব দোকান থেকে চমচম কিনে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। আসল-নকল চমচম চেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। পোড়াবাড়ির আসল চমচমের কারিগররা অর্থের অভাবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।

অন্যদিকে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে পোড়াবাড়ির নাম ভাঙ্গিয়ে ভেজাল চমচম বিক্রি করে অস্বাধু ব্যবসায়ীরা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। পোড়াবাড়ির চমচম ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। প্রকৃত কারিগর ও ব্যবসায়ীরা আর্থিক লাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তদের অভিমত, এ গৌরবময় ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করার পাশাপাশি ভেজাল চমচম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় ভেজাল আর নকল চমচমের ভিড়ে আসল চমচম চেনা দায় হয়ে পড়বে। হারিয়ে যাবে ঐতিহ্য আর গৌরব।

আনন্দবাজার/এম.আর

সংবাদটি শেয়ার করুন