জলবায়ু পরিবর্তনে মহাবিপর্যয়ের মুখোখুশি বিশ্বকে বাঁচাতে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছেন বিশ্বনেতারা। এর মধ্যে কার্বন নিঃসরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি কয়লা ও ফার্নেস অয়েলের ব্যবহার বন্ধের অঙ্গীকার করেছে বিশ্বের ২৩টি দেশ। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় সম্প্রতি আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৬) এমন অঙ্গীকার করেছেন তারা। একই সঙ্গে কয়লাভিত্তিক জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে মনোনিবেশ করার কথাও বলেছেন দেশগুলোর সরকার প্রধানরা।
তবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সীমিত করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে বেশি মনোযোগী দেশ হিসেবে এখন ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিসীমা বেড়ে চলেছে দেড় দশক আগে থেকেই। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সাল নাগাদ মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জামালপুরের মাদারগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অংশ হিসেবে দেশে যে সবুজ শিল্প বিপ্লব যাত্রা শুরু করেছে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প সেই গতিকে বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ। তাছাড়া জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্ত অবস্থানকে আরো বেশি স্বার্থক করে তুলবে। বিশেষ করে কপ২৬ সম্মেলনে মানবিক প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে যে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয়েছে নবায়নয়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণে বিশ্বে বড় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে।
সূত্রমতে, সবুজ শক্তি বা গ্রিন এনার্জির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অসামান্য সাফলতার বিষয়টি উঠে এসেছে গেল বছরের ‘রিনিউয়েবল ২০২০ গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট (জিএসআর)’ এর প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষ করে অফ-গ্রিড সোলার সলিউশনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান দখল করেছে। যেখানে অতিরিক্ত ১১ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে হিমালয়কন্যা নেপালের অবস্থান প্রথম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অফ-গ্রিড সলিউশন বাস্তবায়নের জন্য সফল ব্যবসায়ী মডেল হিসেবে পিয়ার-টু-পিয়ার ইলেকট্রিসিটি ট্রেডিং কনসেপ্ট বা সোয়ার্ম ইলেকট্রিফিকেশনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে ব্যাপকভাবে পরীক্ষিত।
আগামী কয়েক বছরে দেশে বিদ্যুৎ খাতে নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর বিদ্যুতের হিস্যা আরো বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে ২৩টি নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ের কার্যক্রম চলমান। এসব কেন্দ্রের সম্মিলিত উৎপাদনক্ষমতা ধরা হয়েছে এক হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। দেশের সবচেয়ে বড় সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র শেখ হাসিনা সোলার পার্কটি নির্মাণ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। ২০২৩ সালের মধ্যে পার্ক তৈরির কাজ শেষ করবে সংস্থাটি। এখানে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করা হবে। এছাড়া পরবর্তী সময়ে মুরগির খামার করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) সূত্রমতে, বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে উৎপাদন হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা করার কারণে প্রকল্পটি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে ধরা হয়েছে।
আরপিসিএল সূত্রমতে, ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ৩২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ করেছে আরপিসিএল। ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি-৩) আওতায় প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থায়ন করছে প্রতিবেশী দেশ ভারত।
খসড়া প্রস্তাব থেকে জানা যায়, ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রটি মূলত শেখ হাসিনা সোলার পার্ক হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে এক হাজার ৫১১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এলওসি-৩-এর আওতায় সোলার প্রকল্পে ভারত এক হাজার ১১৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে। বাকি ৩১৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা সরকারি অর্থায়ন ও ৭৬ কোটি টাকা আরপিসিএলের।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে, মাদারগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট এবং কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) কাজ সম্পাদন, ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৩২৫ দশমিক ৬৫৩৬ একর ভূমি উন্নয়ন, ১৩২ কেভি ৪৭ কিলোমিটার (প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে ঘাটাইল গ্রিড উপকেন্দ্র পর্যন্ত) পাওয়ার ইভাক্যুয়েশন লাইন এবং ইভাক্যুয়েশন অবকাঠামো নির্মাণ, ১০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অফিস বিল্ডিং, ওয়ার্কশপ, ওয়্যারহাউজ এবং আনসার ব্যারাক নির্মাণ, ৮৮টি ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এবং ৩২৫ দশমিক ৬৫৩৬ একর ভূমি দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্ত গ্রহণ।
জামালপুরের ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মূলত নির্মাণ করা হচ্ছে চরাঞ্চলের ভূমিতে। প্রায় এক দশক আগে জেগে ওঠা চরটিতে খুব বেশি জনবসতি নেই। দুই বছর আগে স্থানটিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পরিকল্পনা নেয় আরপিসিএল। জেগে ওঠা চরটি সরকার অধিগ্রহণ করার পর আরপিসিএলকে জমি বরাদ্দ দেয় ভূমি মন্ত্রণালয় ও জামালপুর জেলা প্রশাসন।
পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগ সদস্য (সচিব) শরিফা খান বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বহুমূখীকরণের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমবে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
সূত্রমতে, ২০১৭ সাল থেকে দেশে এখন পর্যন্ত সাতটি সোলার পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ১৩০ মেগাওয়াট। এরই মধ্যে সোলার পার্কগুলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বেশির ভাগ পার্ক নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। স্থাপিত সোলার পার্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র ময়মনসিংহের গৌরীপুরে অবস্থিত। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদনক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট।
চলতি বছরের জুনে কারখানার ছাদে স্থাপিত দেশের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়। দেশের প্রথম বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কোরিয়ান ইপিজেডের কারখানা ভবনের ছাদে স্থাপিত এই সোলার প্যানেল থেকে আসবে ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রমতে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে সরকার আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। জামালপুরের মাদারগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি সেখানে একই সক্ষমতার আরো সোলার পার্ক নির্মাণ করছে বিপিডিবি, আরপিসিএল ও পাওয়ার জেন। এ প্রকল্পের জন্য ৩৪৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রটির বিদ্যুতের ট্যারিফ ১১ টাকা ৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসার কথা। তবে এখন পর্যন্ত তা সাড়ে তিন ভাগের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৭৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। যার মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ থেকে উৎপাদন হচ্ছে ৫৩২ মেগাওয়াট।
২০১৭ সালের ৯ জুলাই রাঙামাটির কাপ্তাই প্রজেক্টের ভেতর কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান বাঁধ সংলগ্ন খালি জায়গায় ২৩ একর জায়গার ওপর সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয়। প্রায় দুই বছর পর ২০১৯ সালের মে মাসে সেই কেন্দ্র থেকে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়।
আনন্দবাজার/শহক