ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চামড়া শিল্প: রফতানি বাড়লেও কাটছেনা নানা সংকট

চামড়া শিল্প: রফতানি বাড়লেও কাটছেনা নানা সংকট

বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে ব্রিটিশ আমলে (১৯৪০) তৎকালীন ব্যবসায়ী রণদা প্রসাদ সাহার (আরপি সাহা) হাত ধরে গড়ে ওঠা ট্যানারি শিল্প আজ দেশের অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে পরিণত হয়েছে। বন্দরনগরী থেকে হাজারিবাগ হয়ে আধুনিক শিল্পের রূপ পেয়েছে রাজধানীর সাভারে। দেশের প্রধান রফতানিখাত পোশাক শিল্পের পরই স্থান করে নিয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প। বর্তমানে দ্রুত বর্ধিত রফতানি আয়ের প্রায় নয় শতাংশ আসে চামড়া শিল্প থেকে। গেল আট দশকের ব্যবধানে বর্তমানে দেশে ট্যানারির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭০টিতে। আর এ শিল্পের ওপর ভর করে বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন অন্তত নয় লাখ মানুষ।

দীর্ঘদিন ধরেই রফতানি সংক্রান্ত সংকটে ভুগছিল চামড়া শিল্প খাত। করোনাভাইরাস মহামারিতে এসে তাতে আরো ধস নামে। তবে গত বছর থেকের মেঘ কাটতে শুরু করেছে। গেল অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ৭৬ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। আর এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ চার বছর পর প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে এ খাতের রফতানি।

বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রধান বাজার ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার প্রাদুর্ভাব কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে শুরু করায় চাহিদা বেড়ে রফতানিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আগামী দিনগুলোতে এ খাতে রফতানি আরও বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছেন এখাতের রফতানিকারকরা। অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, নানা সংকটের মধ্যেও চামড়া রফতানি বেড়েছে। বিদ্যমান সংকটগুলো কেটে গেলে এখাতের সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে করে ১১৩ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ১১৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই আয় আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে চামড়া শিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয়। তবে এর মধ্যেই বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে ২০১৭ সালে ট্যানারি শিল্পকে হাজারিবাগ থেকে হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হয়। চামড়া শিল্প হঠাৎ করেই স্থানান্তরের ফলে নতুন স্থানে কারখানা স্থাপন এবং পুরোদমে উৎপাদনে যেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় অনেক বিদেশি ক্রেতা হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর থেকেই ধস নামে এ খাতের রফতানিতে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও কমে ১০২ কোটি ডলারে নামে। গেল ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরের ১০ মাসে অর্থাৎ জুলাই-এপ্রিল সময়ে এই খাত থেকে আয় হয়েছে ৭৬ কোটি এক লাখ ডলার। এই ১০ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে এক শতাংশের মতো।

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৯ কোটি ৬১ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। চামড়া থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে এসেছে ২০ কোটি ৩১ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ শতাংশ। আর চামড়ার জুতা রফতানি করে আয় হয়েছে সবচেয়ে বেশি ৪৬ কোটি ১৭ লাখ ২০ হাজার ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ শতাংশের মতো।

সম্ভাবনা যেখানে থমকে আছে
চামড়া খাতকে এক সময় সম্ভাবনাময় মনে করা হলেও এটি ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় শীর্ষ এই রপ্তানি খাত এখন চতুর্থ স্থানে নেমে এসেছে। হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী সাভারে স্থানান্তর নিয়ে দীর্ঘ জটিলতার কারণেই এ শিল্পের এই হাল হয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী সাভারে স্থানান্তরে প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষের কথা ছিল। কিন্তু ১৯ বছর পার হয়ে গেলেও এই শিল্পনগরী পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠেনি।

প্রকল্প শেষ না হলেও ২০১৭ সালে উচ্চ আদালত হাজারীবাগের চামড়া কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয়। ফলে সব কারখানায় উৎপাদন থেমে যায়। এর মধ্যে বেশ কিছু চামড়া কারখানার বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ ছিল। এ সুবাদে তারা জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকায় চামড়া রফতানি করতে পারত। হাজারীবাগে কারখানা বন্ধ হওয়ায় সেই সনদ ও বায়ার (বিদেশি ক্রেতা) হারায় চামড়া শিল্প কারখানাগুলো।

এত দীর্ঘ সময়েও সাভারের চামড়া শিল্পনগরী পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত না হওয়ায় এখনও এলডব্লিউজির সনদ ফিরে পায়নি কারখানাগুলো। একই সঙ্গে নতুন বাজার সৃষ্টি হয়নি। সনদ না থাকায় জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকায় এলডব্লিউজির আওতায় তারা চামড়া রফতানি করতে পারছে না। আর এ বিধি-নিষেধের কারণে এসব কারখানা থেকে কাঁচামাল নিয়ে পণ্য উৎপন্ন করে সে পণ্য রফতানিও করতে পারছে না রফতানিকারকরা।

হাজারীবাগ থেকে উচ্ছেদ করা ছোট ছোট ট্যানারির মালিকরা সাভারস্থ নিজস্ব প্লটে এখনো অর্থাভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারেননি। এ খাতের অনেক উদ্যোক্তাই আগে থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়ে আছেন। সে কারণে তারা নতুন ঋণ সংগ্রহ করতে পারেননি। প্রকল্প এলাকায় কারখানা ভবন নির্মাণ, নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি, পুরনো যন্ত্রপাতি স্থানান্তর ইত্যাদি কাজে উদ্যোক্তাদের বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকা, আয় না থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, বিদ্যমান ঋণের কিস্তি বা সুদ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার কারণে অনেক উদ্যোক্তা আর্থিক সংকটে পড়েছেন।

হাজারীবাগের পরিত্যক্ত জমি রাজউক রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেজন্য ট্যানারি মালিকরা তাদের জমি বা স্থাপনা বিক্রয় কিংবা বিকল্প কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারছেন না। সেটি করতে পারলে তাদের অর্থকষ্ট কিছুটা লাঘব হতে পারতো। অন্যদিকে রাজউক এ জমি অধিগ্রহণও করার ইচ্ছা পোষণ করছে না।

সহায়ক পদক্ষেপ
দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের যে উত্থান ও সম্প্রসারণ হয়েছে, তার পেছনে সরকার প্রদত্ত সহজ শর্তে ঋণ, শুল্ক ও কর অব্যাহতি এবং ক্যাশ প্রণোদনাসহ পরিবহন ও বন্দরে সব রকম লজিস্টিক সুবিধা যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। ২০২৪ বা ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হবে। তখন ইউরোপীয় বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে গড়ে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ হারে শুল্ক দিয়ে ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। তৈরি পোশাক শিল্প বিপর্যয়ে পড়ার আগেই বাংলাদেশকে ইউরোপের বাজারে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হবে। বিকল্প হিসাবে অন্য কোনো খাতকে রপ্তানিতে যোগ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এ সম্ভাবনাময় খাতটি হলো চামড়া শিল্প খাত।

সাভার চামড়া শিল্প নগরীর সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো পরিবেশসম্মতভাবে সম্পন্ন না হওয়ায় বেসরকারি মালিকদের পরিচালনার জন্য গঠিত কমিটির কাছে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পুরোপুরি হস্তান্তর করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিগত প্রায় বিশ বছর ধরে চলমান প্রকল্পটি জুন ২০২১-এর পর আর বর্ধিত করা সমীচীন কিনা, তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন।

ট্যানারি ও চামড়াজাত দ্রব্যের প্রস্তুতকারী শিল্প মালিকদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো কমপ্লায়েন্স। ইএসকিউ (এনভায়রনমেন্ট, সোশ্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটি), আইএসও এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই আন্তর্জাতিক ক্রেতা আকৃষ্ট হবে এবং তা এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে সহায়ক হবে।

চামড়া খাতকে শক্তিশালী করতে ট্যানারি কারখানার আধুনিকায়ন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে, চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত উপকরণের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঠিক পদ্ধতিতে পশুর শরীর থেকে চামড়া ছাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণ এবং পাচার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক প্রচার এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

আনন্দবাজার/এম.আর

সংবাদটি শেয়ার করুন