বৈশ্বিক মহামারী করোনার ফলে সারা বিশ্বের শিল্প প্রতিষ্ঠান অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি অনেকটায় স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে শিল্প-কারখানায় চঞ্চলতা ফিরে আসতে শুরু করেছে।
যার ফলে আর্ন্তজাতিক বাজারে শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়লেও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি জোগান। এতে বাজারে পণ্যের সরবরাহ সংকট তৈরি পাশাপাশি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে এসব পণ্যের দাম।
যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের শিল্প বাজারও। দেশের নির্মাণশিল্পে—বিশেষ করে সিমেন্ট ও ইস্পাতের রডের দামে মারাত্মক চাপে ফেলতে চলেছে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
সিমেন্ট কারখানাগুলো প্রতি মাসে ৩০০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে
আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধির কারণে দেশের সিমেন্ট কারখানাগুলো প্রতি মাসে ৩০০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফেচারার অ্যাসোসিয়েশেনের (বিসিএমএ) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
তিনি জানান, ২০২২ সালের আগে দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
স্থানীয় বাজারেও কাঁচামালের দামবৃদ্ধির কারণে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে পেয়েছে ভোক্তাপণ্যের দাম। এতে বিক্রি কমে যাচ্ছে। উৎপাদিত পণ্য জমা হচ্ছে গুদামে। বাধ্য হয়ে উৎপাদন সীমিত করতে হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠানকে।
এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন শিল্পমালিকরা। তারা বলছেন, পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে পণ্য বিক্রি কমে। ফলে অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘এই অবস্থা চলতে থাকলে ৩০ শতাংশ সিমেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।’
এক বছরে ইস্পাতের দাম বেড়েছে ২০ হাজার টাকা
দেশের বাজারে বর্তমানে ইস্পাত তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল স্ক্র্যাপ লোহা বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৫০ হাজার টাকা দামে। যা এক বছর আগে ৩০-৩২ হাজার টাকায় পাওয়া যেতো। এর ফলে ভোক্তা পর্যায়ে এক বছরে ইস্পাতের দাম বেড়েছে ২০ হাজার টাকা।
এ নিয়ে দেশের প্রথম সারির ইস্পাত উৎপাদক কেএসআরএম-এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘ভোক্তার ওপর খরচের চাপ যখন বাড়বে, তখন সে খরচ কমিয়ে আনতে বাধ্য হবে। তখন অর্থনৈতিক চক্র মন্থর হবে।’
ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে
দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী বলেন, আর্ন্তজাতিক বাজারে গত তিন মাস ধরে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক রকম চড়া।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে ৪৫০ ডলারের প্রতি টন ভোজ্যতেল (পামঅয়েল) এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০০ ডলারে। একইভাবে টনপ্রতি ২৬৫ ডলারের গম এখন ৪৫৫ ডলার এবং টনে ৫৫০ ডলারের মসুর ডাল ৯৫০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া, ডলারের দাম ও জাহাজভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।’
তিনি আরো বলেন, দেশে চাহিদার তুলনায় ভোগ্যপণ্যের আমদানি ও সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। কিন্তু বাড়তি দামে পণ্য কেনায় আমদানিকারকরাও বাড়তি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম না কমলে দেশেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করেন এই আমদানিকারক।
ঢেউটিনের কাচাঁমালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি
আর্ন্তজাতিক বাজারে ঢেউটিনের কাচাঁমালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন ও বিক্রির দাম সমন্বয় নিয়ে শঙ্কিত এখাতে সংশ্লিষ্টরা।
পিএইচপি শিল্প পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আমির হোসেন সোহেল বলেন, করোগেটেড শিটের প্রধান কাঁচামাল এইচআর কয়েলের দাম দুই বছরের মধ্যে টনপ্রতি ৪০০ ডলার থেকে ১ হাজার ২০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। আরেক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ফসফরিক এসিডের প্রতি কেজির মূল্য ছয় মাসের ব্যবধানে ১৯০ থেকে ৪৩০ টাকায় পৌঁছেছে । এসব বাড়তি দামে কিনলে উৎপাদনের খরচও বাড়ে।
আকাশছোঁয়া এলএনজির দাম
রেকর্ড মূল্যে এলএনজি আমদানি করায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) মূল্যবৃদ্ধি সরকারের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে। সেইসঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকট তো আছেই।
আকাশছোঁয়া এলএনজির দাম বিদ্যুতসহ বিভিন্ন পণ্যের খরচও বাড়িয়ে দিয়েছে।
দুই মাস আগে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ-তে ১৩-১৫ ডলারের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু অক্টোবরের জন্য বাংলাদেশ রেকর্ড মূল্যে দুটি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কার্গো কিনেছে।
এদিকে, বিশ্ববাজারে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে এলএনজিতে সরকারি ভর্তুকি বেশি দিতে হবে।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে পেট্রোবাংলা পূর্বাভাস দিয়েছিল যে ভর্তুকি হিসেবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখন প্রতিষ্ঠানটির ধারণা, ভর্তুকির পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
আনন্দবাজার/শহক