দেশে প্রচন্ড দাবদাহ চলছে। রমজানও চলে এসেছে। দাবদাহ উপেক্ষা করেই রূপগঞ্জের কৃষাণিরা মুড়ি ভাজার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
মুনতাজ বেগম একজন মুড়ি ভাজার কারিগর। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, এবার অনেক গরম পড়ছে। রোজাও আইসা পড়ছে। রমজান মাস শুরু হতে আর কয়েক দিন বাকি। রমজানে ইফতার মুড়ি ছাড়া কল্পনা করা যায় না। তাই রমজান উপলক্ষে ইফতারের অন্যতম খাবার মুড়ি ভাজার ধুম পড়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে।
উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন, সদর ইউনিয়ন, দাউদপুর ইউনিয়ন, ভোলাব ইউনিয়ন, ভুলতা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সারা বছর ধরেই চলে মুড়ি ভাজার কর্মযজ্ঞ । পবিত্র মাহে রমজানকে সামনে রেখে আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন মুড়ি তৈরির কারিগররা। দেশজুড়ে মুড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকায় শ্রমিকরা যেমন হয়ে ওঠেন স্বর্নিভর তেমনি এলাকার দরিদ্র মানুষেরা খুঁজে পাচ্ছেন কাজ। রমজানের ইফতারে ছোলা ও মুড়ি গ্রামবাংলার প্রধান দু’টি উপাদান। রোজার সময় হাটেবাজারে মুড়ি, ছোলা পাওয়া গেলেও বাড়িতে মহিলাদের মুড়ি ভাজার রেওয়াজ এখনও রয়েছে।
গত এক সপ্তাহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, রূপগঞ্জের বেশ কিছু সংখ্যক গ্রামে এখন চলছে মুড়ি ভাজার ধুম। প্রচন্ড দাবদাহ উপেক্ষা করেই বাড়ি বাড়ি মুড়ি ভাজার কার্যক্রম চলছেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এদেরকে থামাতে পারছে না। দিনরাত ২৪ ঘন্টাই মুড়ি ভাজার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপজেলার শতাধিক পরিবারের নারী-পুরুষ। মুড়ি ভাজার মূল কারিগর নারী হলেও তাদের সাথে এক যোগে কাজ করছেন পুরুষরাও। নিতান্তই সখের বসে মুড়ি ভাজতে গিয়ে কেউ কেউ এটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
উপজেলার কামশাইর এলাকার শিক্ষক মোঃ তরিকুল ইসলাম বলেন, বাড়িতে ভাজা মুড়ির মঝাই আলাদা। শুধু রোজায় নয়, সারা বছর খাওয়ার জন্য মুড়ি ভাজা হয়। তবে এ সময়টায় মুড়ির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। খামার পাড়া এলাকার মাজেদা আক্তার বলেন, রমজানে মুড়ি ভেজে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি পাঠাতে হয়। এটা আমাদের গ্রামের রেওয়াজ। তাই প্রতি বছর রোজাকে সামনে রেখে মুড়ি ভাজতে হয়। এ কাজে মুড়ি ভাজতে পটু (অভিজ্ঞ) মহিলাদের এ সময় কদর বেড়ে যায় বহুগুণ। এক কেজি চালের মুড়ি ভাজতে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত মজুরি দিতে হয় বলেও তিনি জানান। অথবা এক মণ মুড়ি ভাজলে একটিন মুড়ি ও ২ কেজি চাল কারিগরকে দিতে হয়।
মুড়ি ভাজতে পটু উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের উত্তরপাড়া এলাকার মল্লিকা রানী জানান, সারা বছর মুড়ি ভাজার প্রয়োজন না পড়লেও অনেকেই রোজার সময় মুড়ি ভাজার জন্য আমাদের ডাক দেন। কোনো রকম দামাদামি নয়, খুশি হয়ে যা দেন তা ই নেই”। সকিনা বেগম নামের আরেকজন মুড়ি ভাজার কারিগর বলেন, ধারনা না থাকলে মুড়ি ভাজা ভাল হয় না বলে আমাদের দিয়ে রোজার সামনে অনেকে মুড়ি ভাজিয়ে নেন। স্মৃতি হাতড়ে বরুনা এলাকার বৃদ্ধা নুরভানু বেগম জানান, এখন তো বাজার থেকে চাল নিয়ে এসেই মুড়ি ভাজা যায়। আগে অর্থাৎ আমাদের সময়ে মুড়ির জন্যে আলাদা ধান রাখা, সেটা সিদ্ধ করা ও মুড়ি ভাজার কাজ বাড়ির বৌ-ঝিকেই করতে হতো। কষ্ট হলেও সবাই এক সঙ্গে করতো বলে উৎসব উৎসব মনে হতো।
কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক স্বর্ন পদক প্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান খান বলেন, বাজারের মুড়িতে নানা রকম ভেজাল জিনিষ মেশায় বলে মানুষজন বাড়িতে মুড়ি ভাজে। বাড়িতে ভাজা মুড়ির স্বাদের তুলনা হয় না। তবে এ রেওয়াজ ভবিষ্যতে কত দিন চলবে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে এখানকার মুড়ি তৈরির কারিগরদের প্রশিক্ষণ ও সহজ শর্তে ঋণ দান করা উচিৎ। রাসায়নিক মুক্ত এ মুড়ির বাজার সম্প্রসারণ হলে ঐতিহ্য রক্ষার পাশপাশি গ্রামীণ এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুশরাত জাহান বলেন, গ্রাম আর শহর কি, ইফতার মানেই মুড়ি, মুড়ি ছাড়া ইফতার পরিপূর্ন মনে হয় না। তবে দোকানের কেনা বা মেশিনে বানানো মুড়ির চেয়ে বাড়িতে ভাজার মুড়ির স্বাদই আলাদা।
আনন্দবাজার/শাহী/ফয়সাল