বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানার মৌভোগ কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রভাইডার হিসেবে মিঠুন হীরা গত ৯ বছর স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে আসছিলেন মৌভোগ ইউনিয়নের সাধারন মানুষদের। হিন্দু-মুসলিম সকলের কাছেই তিনি ছিলেন প্রিয় মানুষ। দিন অথবা রাতে গ্রামের যে কোনো অসুস্থ মানুষেরআহব্বানে সাড়া দিয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়ে পৌছে যেতেন অসুস্থ মানুষের পাশে। গত বছরের করোনা মহামারীর সময়েও তিনি ছিলেন করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখসারির যোদ্ধা। সারা দেশে যখন লকডাউন, সাধারন মানুষ যখন করোনার আতঙ্কে গৃহবন্দী, তখন ও সাধারন মানুষের দ্বাওে দ্বারে স্বাস্থ্য সেবা পৌছে দিতে পিছপা হয়নি তিনি।
ষাটোর্ধ কালীদাশ হীরা ও পঞ্চাশর্ধ ইলা রানী হীরার একমাত্র সন্তান মিঠুন হীরা। ছেলে ও ছেলের বৌ সান্তনা রায় কে নিয়ে সাজানো গোছানো সংসারে গত বছরের ২৫শে সেপ্টেম্বর করোনানামক এক অদৃশ্য শত্রæর ছোবলে একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবারটি।
মিঠুনের বাবা কালিদাস হীরা বলেন, একমাত্র ছেলে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে করোনা সংকটে সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কাজ করেছে। মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবনটাও দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত সরকার তার আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করেনি। সরকার করোনাযোদ্ধাদের ঝুঁকি ভাতার প্রতিশ্রুতি দিলেও মিঠুনের ক্ষেত্রে সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি। মিঠুন মারা যাওয়ার পনেরো দিন পরে উপজেলা পরিসংখ্যান অফিস ও ফকিরহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিভিন্ন কাগজপত্র ও ক্ষতিপূরণের আবেদনপত্র জমা দিলেও এখনো পর্যন্ত সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতা পায়নি তারা।
মিঠুনের মা ইলা রাণী হীরার সাথে কথা বলতে গেলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। ছেলের বিষয়ে জানতে চাইলে ভাষা হারিয়ে ফেলা মায়ের বাকরুদ্ধ অশ্রু সজল নয়ন জানান দিচ্ছিলো, সন্তান হারানোর শোক এখনো তাড়া করে ফিরছে তাকে। চোখের জলের নির্বাক আকুতি যেন ফিরে পেতে চায় হারানো সন্তানকে।
মিঠুনের ছোট চাচা প্রহ্রদ হীরা জানান, স্বাস্থ্যকর্মী মিঠুন হীরা গত বছরের সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ করোনা কালিন সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পর খুলনা মেডিকেল কলেজে মিঠুনের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার পর ১৩ তারিখে জানতে পারেন যে সে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা আক্রান্তের মেডিকেল রিপোর্ট হাতে পেয়ে চিকিৎসার জন্য তাকে ১৪ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত খুলনা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলে তাকে বয়রা রেলিগেটের নূরনগর এলাকার করোনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ তারিখ সে মারা যায়।
গত বছরের ২৩ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হলে অথবা করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তাদের বেতন স্কেল অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে।
গ্রেডভেদে ক্ষতিপূরণ উল্লেখ করে পরিপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৫ এর বেতন স্কেল অনুযায়ী ১৫-২০ তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাবে পাঁচ লক্ষ টাকা, মারা গেলে পাবে ২৫ লক্ষ টাকা। ১০-১৪ তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা, মৃত্যু হলে ৩৭ লক্ষ টাকা এবং ১ম-৯ম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ১০ লক্ষ টাকা ও মৃত্যুবরণ করলে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। সেই সাথে পরিপত্রের ঘোষণা অনুযায়ী পহেলা এপ্রিল থেকে তা বাস্তবায়নের নির্দেশনাও প্রদান করা হয়।
পরিপত্রের ঘোষণা অনুযায়ী করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া স্বাস্থ্যকর্মী মিঠুন হীরা সরকারিভাবে কোনো প্রকার আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাবে কি না সে বিষয়ে জানতে ফকিরহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা অসিম কুমার সমাদ্দারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, মিঠুন হীরার সকল কাগজপত্র ও ক্ষতিপূরণের আবেদনপত্র কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়েছে। মিঠুন হীরা কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তিনি সরকারী কর্মচারী ছিলেন না। তবে যদি অন্য সকল করোনা আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মী ক্ষতিপূরণ পায় তাহলে মিঠুন হীরার পরিবারও ক্ষতিপূরণ পাবেন। তিনি আরো জানান, মিঠুন হীরার ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির জন্য আন্তরিকভাবেই কাজ করছেন তারা।
আনন্দবাজার/শাহী/মফিজ