ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নকলের ভীড়ে ঐতিহ্য হারাচ্ছে কুমিল্লার আসল রসমালাই

কুমিল্লার রসমালাই, নাম শুনলেই জিভে পানি আসে নিশ্চিত। কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টান্নের খ্যাতি রয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও। কুমিল্লায় গেছেন, কিন্তু রসমালাইের স্বাদ নেয়নি এমন মানুষ পাওয়াই দুষ্কর। দেশের বিভিন্ন স্থানে রসমালাই তৈরি হলেও তাই কুমিল্লার রসমালাই স্বাদে অতুলনীয়।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভেজাল ও নকল রসমালাইয়ের কারণে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী এ রসমালাইয়ের সুনামে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। কুমিল্লাজুড়ে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাঙের ছাতার মতো নকল ও ভেজাল রসমালাইয়ের কারণে ঐতিহ্য হারাচ্ছে দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়ানো জনপ্রিয় এ মিষ্টান্ন।

জানা যায়, স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকেই কুমিল্লার রসমালাই, দই ও মিষ্টির সুনাম দেশের সর্বত্র। বিশেষ করে কুমিল্লার রসমালাইয়ের চাহিদা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। যে অমৃত স্বাদ আর ঐতিহ্যের কারণে রসমালাইয়ের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে, ভেজাল আর নকলের ভিড়ে সেই স্বাদ এখন বিলুপ্তপ্রায়। অসাধু এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ঐতিহ্যবাহী রসমালাইয়ের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম নকল করে বা ওই নামের সামনে-পেছনে অন্য শব্দ ব্যবহার করে ভেজাল কিংবা নকল রসমালাই তৈরি করে বিক্রি করছে দেদারসে। এতে বোঝারই উপায় নেই কোনটি আসল রসমালাই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আর কোনটি নকল।

কুমিল্লার রসমালাইয়ের শুরুর কথা: কুমিল্লা রসমালাইয়ের আদি উদ্ভাবক ত্রিপুরা রাজ্যের ঘোষ সম্প্রদায়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা থেকে ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী এ অঞ্চলের লোকদের বাহারি রকমের মিষ্টি সরবরাহ করতেন। সে সময় রসগোল্লার সঙ্গে মালাইকারির প্রলেপ দেওয়া এক প্রকার মিষ্টির প্রচলনও ছিল। কেউ কেউ একে মালাই রসগোল্লা বলতেন।

পরবর্তী সময়ে দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীর বানিয়ে তার মধ্যে শুকনা রসগোল্লা ডুবিয়ে তৈরি করা হয় ক্ষীরসহ রসগোল্লা। এর নাম দেয়া হয় ‘ক্ষীরভোগ। ’ গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে এই রসগোল্লার আকার ছোট করে দুধের ক্ষীরের মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন শুরু হয় এবং একপর্যায়ে এর নামকরণ হয় রসমালাই।

কুমিল্লার রসমালাই, নাম শুনলেই জিভে পানি আসে নিশ্চিত। কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টান্নের খ্যাতি রয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও। কুমিল্লায় গেছেন, কিন্তু রসমালাইের স্বাদ নেয়নি এমন মানুষ পাওয়াই দুষ্কর। দেশের বিভিন্ন স্থানে রসমালাই তৈরি হলেও তাই কুমিল্লার রসমালাই স্বাদে অতুলনীয়।
 নকলের ভীড়ে ঐতিহ্য হারাচ্ছে কুমিল্লার আসল রসমালাই

তবে অনেকের মতে, পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর অবাঙালিরা কুমিল্লায় এসে ক্ষীরভোগকে রসমালাই বলতে শুরু করেন। প্রথম দিকে মাটির হাঁড়িতে করে বিক্রি হতো রসমালাই। পরে পলিথিনের ঠোঙা ও এরপর আসে প্লাস্টিকের কৌটায় করে বিক্রির প্রথা।

কোথায় মেলে প্রকৃত স্বাদের রসমালাই: কুমিল্লা নগরীজুড়ে এখন যত্রতত্র ভেজাল রসমালাই বিক্রির দোকান। এর অধিকাংশই প্রকৃত স্বাদের আসল রসমালাই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান নয়। বর্তমানে প্রকৃত স্বাদের রসমালাই পাওয়া যায় হাতে গোণা কয়েকটি মিষ্টির দোকানে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী পেড়া ভান্ডার, শীতল ভান্ডার, জলযোগ, জেনিস, পোড়াবাড়ি, পুলিশ লাইনের পিয়াসা, ঝাউতলার অমৃত সুইটস ও পিয়াসার মিষ্টি দোকান।

তবে উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু রসমালাই পেতে হলে আসতে হবে মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী ও শীতল ভান্ডারের দোকানে।

কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারের আদি প্রতিষ্ঠান মনোহরপুরের মাতৃভান্ডার। এটি স্থাপিত হয় ১৯৩০ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা ফনিন্দ্র সেন গুপ্ত। তাদের আদি বাসস্থান ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। প্রকৃত রসমালাই বিক্রির এ দোকানগুলোতে নেই কোনো চাকচিক্য। দোকানে বসার ব্যবস্থাও নেই। বাইরের চাকচিক্যের চেয়ে স্বাদ এবং মানই এসব দোকানির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে তারা জানান।

কি পরিমাণ রসমালাই তৈরি হয় কুমিল্লায়: কুমিল্লার রসমলাইয়ের দোকানগুলোর মধ্যে মাতৃভান্ডারেই প্রতিদিন গড়ে ৮/৯ মণ রসমালাই তৈরি করা হয়। এসব দোকানে প্রতিদিন ভোরে ও বিকেলে ৫-৬ জন দুধ ব্যবসায়ী প্রায় ১৫-২০ মণ দুধ সরবরাহ করে থাকেন। মাতৃভান্ডারে প্রতিদিন ৩ বার নির্দিষ্ট কারিগর দিয়ে রসমালাই তৈরি করা হয়।

রসমালাইয়ের বেচাকেনা: প্রতিদিন ভোর থেকে ‍রাত পর্যন্ত এ দোকানগুলোতে চলে বেচাকেনা। স্থানীয়রা ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে ও কুমিল্লায় বেড়াতে আসা লোকজন রসমালাই কিনতে ভুল করেন না। দেশের মানুষ ছাড়াও বিদেশিদের কাছে এই রসমালাইয়ের স্বাদ ও সুনাম পরিচিত।

বিদেশি অতিথি আপ্যায়নেও রসমালাই: বাংলাদেশে আগত বিদেশি মেহমান আপ্যায়নের মেন্যুতেও সরব উপস্থিতি থাকে কুমিল্লার রসমালাইয়ের। রাষ্ট্রীয় সফরে আসা অতিথিদের সম্মানে আয়োজিত মধ্যাহ্ন ভোজেও রাখা হয় কুমিল্লার রসমালাই।

ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য বিশেষ রসমালাই: ডায়াবেটিক রোগীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিষ্টি এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তারা যাতে কুমিল্লার রসমালাইয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য এখন ডায়াবেটিক রসমালাইও তৈরি হচ্ছে। এটি প্রথম তৈরি শুরু করে শহরের নজরুল এভিনিউতে অবস্থিত অমৃত মিষ্টি ভাণ্ডার।

রসমালাইয়ের দরদাম: একসময় কুমিল্লার রসমালাইয়ের সাধারণের নাগালের মধ্যে থাকলেও দিনদিন বাড়ছে এর দাম। বর্তমানে কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারে ১ কেজি রসমালাইয়ের দাম ২৮০ টাকা, আর ১ প্লেটের দাম ৫০ টাকা। অন্যান্য দোকানেও প্রায় একই দাম।

রসমালাই বিক্রেতারা জানায়, শুধু মাতৃভান্ডারেই প্রতিদিন বিক্রি হয় প্রায় কয়েক লাখ টাকার রসমালাই। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বিক্রির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। বিক্রির দিক থেকে মাতৃভান্ডারের পরই ভগবতী ও শীতল ভান্ডারের নাম আসে। এই দুই দোকানেও প্রতিদিন প্রায় লাখ টাকার বেশি রসমালাই বিক্রি হয়।

যত্রতত্র নকল মাতৃ ভান্ডার: ব্যাঙের ছাতার মতো কুমিল্লায় ও দেশের যত্রতত্র গড়ে উঠছে নকল মাতৃভান্ডারসহ অন্য প্রসিদ্ধ রসমালাই প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের শো-রুম। এতে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। কুমিল্লা শহরের রেল স্টেশন, গুরুত্বর্পূণ বাসস্ট্যান্ড, আলেখারচর বিশ্বরোড, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, হাইওয়ে রোডের বড় বড় হোটেলগুলোসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ৯৭ কিলোমিটার রাস্তার আশেপাশে গড়ে উঠছে এসব নকল শো-রুম।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর, চাঁদপুর প্রভৃতি জেলায় ভ্রমণকারী লোকজন যাত্রাপথে গাড়ি থামিয়ে মূলত এসব দোকান থেকেই রসমালাই কিনে প্রতারিত হন।

কুমিল্লার মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস বলেন, আমাদের মাতৃভান্ডারের কোথাও কোনো শাখা নেই। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা মাতৃভান্ডারের নামের আগে নিউ, প্রিয়, আদি, কুমিল্লা ইত্যাদি শব্দ যুক্ত করে রসমালাই বিক্রি করছে। এতে করে যেমনিভাবে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি করে কুমিল্লার ঐহিত্যবাহি রসমালাইয়ের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।

আনন্দবাজার/শাহী/আলাউদ্দিন

সংবাদটি শেয়ার করুন