জাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সৃজন করে জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সম্পাদক মোহাম্মদ শাজাহান গংয়ের বিরুদ্ধে।
মাহবুবুল হক নামের যে পাওয়ার অব অ্যার্টনির মাধ্যমে মায়া রাণীর কাছ থেকে জমি কিনে দখল নিয়েছেন শাজাহান গংরা, সেই মাহবুবুল হকের কোনো অস্থিত্বই খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কাল্পনিক মাহবুবুলকে ব্যবহার করে জাল পাওয়ার অব অ্যার্টনি সৃজন করে ১৭ শতক জমি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সম্পাদক এই মোহাম্মদ শাজাহানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে। দলিলে জমির প্রকৃত মালিক মায়া রাণীর যে বয়স দেখানো হয়েছে বাস্তবতায় সেই বয়স তার ছেলের বয়সের চেয়েও কম। মায়া রাণীর ছেলে কাজল মহাজনের অভিযোগ অভিযুক্ত চক্রটি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ছক এঁকে আমাদের সম্পত্তি আত্মসাত করেছে। জমির বিক্রির ৬৪ লক্ষ টাকার মধ্যে গত ২০ মার্চ ২০১৯ সালে ৬৩ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা জমা হয় মাহবুবুল হকের ডাচ বাংলা ব্যাংকের হাটহাজারীর শাখার। এর আগে উক্ত হিসাবে জমা ছিলো মাত্র পাঁচ’শ ৮৫ টাকা। পরের দিন(২১ মার্চ) জমাকৃত অর্থ থেকে চার লক্ষ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন শাজাহানের ছোট ভাই সাজ্জাদ। দালিলিক প্রমাণসহ এমন তথ্য ওঠে এসেছে অনুসন্ধানে।
মাহবুবুল হকের নামের পাওয়ার অব অ্যাটর্নিতে যে জাতীয় পরিচয় পত্র ব্যবহার করা হয়েছে তাও সঠিক নয়। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দলিলে ব্যবহৃত পরিচয় পত্র নাম্বার দিয়ে খোঁজ করলে যে মাহবুবুল হকের নাম পাওয়া যাচ্ছে সেই ব্যক্তি এই মাহবুবুল হক নয় বলে দাবি করছে পিবিআই।
জমির দাতা হিসেবে মায়া রাণীর নামে জাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে হাটহাজারী থানাধীন ফতেয়াবাদ-চিকনদণ্ডি গ্রামের ১৭ শতক জমি আত্মসাতের অভিযোগ এনে গত ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের তৃতীয় আদালতে মামলা দায়ের করেন ওয়ারিশ সূত্রে জমির মালিক মায়া রাণীর ছেলে কাজল মহাজন। মামলায় চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সম্পাদক মোহাম্মদ শাজাহানসহ ১০জন কে আসামী করা হয়। অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্ত করার জন্য পিবিআই চট্টগ্রামকে আদেশ দেন আদালত।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন-মাহাবুবুল হক, সুরেশ দে, মোহাং নুরুল আলম, ফজল করিম, জাহাঙ্গীর কবির, মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, মো. হাবিব উল্লাহ, মো. আবুল হাসেম ও জহির আহম্মদ চৌধুরী।
কাজল মহাজনের অভিযোগ, আমার বর্তমান বয়স ৪৫ বছর অথচ আমার বয়সের চেয়ে ছয় বছরের ছোট এক নারীকে আমার মা মায়া রাণী সাজিয়ে পরিকল্পিতভাবে জাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সৃজন করে জমি কেনার নামে আমাদের পারিবারিক ১৭ শতক সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি। চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজাহান অপরাপর ব্যক্তিদের সহায়তায় জমিটি আত্মসাৎ করেছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, পুত্র কাজল মহাজন এবং দুই কন্যা রীনা নাথ ও কৃঞ্চা নাথকে ওয়ারিশ রেখে চলতি বছর (২০২০) ৩১ মার্চ মারা যান মায়া রাণী। প্রচলিত হিন্দু আইন অনুযায়ী ওয়ারিশ হিসেবে ভোগ দখলে থাকা অবস্থায় গত ১৪ জুলাই কাজল মহাজন হাটহাজারীর চিকনদণ্ডি ইউনিয়নের ভূমি অফিসে খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে দেখেন কাজলের মায়ের নামে নামজারি করা ১৭ শতক নাল জমি দি চিটাগাং কো অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির নামে নামজারি খতিয়ান সৃজিত হয়েছে, শুধু তা নয় খাজনাও পরিশোধ করা হয়েছে। সেখানে কাগজপত্রে মায়া রাণী হিসেবে যে নারীকে দেখানো হয়েছে তার বয়স ৩৯ বছর। জন্ম ১৯৮১ সালের ১৫ জুন।
কাজল মহাজন বলেন, আমার জন্মসাল অনুযায়ী বর্তমানে আমার বয়স ৪৫ বছর। অথচ জমি কেনার জন্য যে নারীকে আমার মা সাজানো হয়েছে তার বয়স ৩৯ বছর! আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট একজন নারী আমার মা হয় কীভাবে?
এজাহার সূত্রে আরও জানা যায়, চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি যে জমিটি কিনেছে তার দাম ৬৪ লক্ষ টাকা। জাল দলিল ও পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সৃজন করে চক্রটি ৬৪ লক্ষ টাকার পুরোটাই অত্মসাত করেছে বলে দাবি কাজল মহাজনের।
কাজল মহাজন বলেন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেখানো মাহবুবুল হকের হাটহাজারী ডাচ বাংলা ব্যাংকের হিসাবের লেনদেনের খতিয়ান বের করলেই জমি কেনার নামে আত্মসাৎ করা টাকার ভাগ কারা পেয়েছেন তা বেরিয়ে আসবে।
কাজল মহাজন আরও বলেন, আমার মা মায়া রাণীর জাতীয় পরিচয় পত্র থাকলেও দলিল ও পাওয়ার অব অ্যাটর্নিতে আমার মা মায়া রাণীর জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দেওয়া হয় নি। সেখানে একটি ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ দাখিল করা হয়েছে যা আমার মায়ের নয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চিটাগাং কো অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সম্পাদক মোহাম্মদ শাজাহান বলেন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে মাহবুবুল হক নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা জমিটি কিনেছি। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি যদি জাল হয় তা হলে এর দায়ভার মাহবুবুল হকের। তিনি আরও বলেন, কোর্টে মামলা হওয়ার পর আমরা তাকে উকিল নোটিশ দিয়েছি। একই সাথে তার নামে থানায় জিডিও করেছি।
তবে সিটিজি নিউজের তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পাওয়ার অব অ্যার্টনিতে মাহবুবুল হকের যে জাতীয় পরিচয় পত্রে হাটহাজারী থানাধীন যে ঠিকানা ব্যবহার হরা হয়েছে তাও সঠিক নয়। ওই ঠিকানায় মাহবুবুল হক নামে কারো অস্থিত্ব খুঁজে পায়নি পিবিআই।
বিষয়টি স্বীকার করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক মো রোস্তাম আলী বলেন, ঐ ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য কয়েকবার নোটিশ পাঠিয়েছি কেউ নোটিশের জবাব দেয়নি। সরেজমিনে সেখানে গিয়েও আমি মাহবুবুল হক নামের কাউকে খুঁজে পাইনি। এলাকার কেউ উক্ত ব্যক্তির বিষয়ে কোনো তথ্য বা পরিচয় জানাতে পারেনি-যোগ করেন রোস্তম আলী।
তিনি আরও বলেন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নিতে মাহবুবুল হকের যে জাতীয় পত্র ব্যবহার করা হয়েছে তাও সঠিক না।
জমি বিক্রির অর্থ মাহবুবুল হকের হাটহাজারী ডাচ বাংলা ব্যাংকের যে হিসাবে জমা হয়েছে তিনি কোন মাহবুবুল হক এবং কিভাবে ঐ হিসাবে টাকা জমা ও উত্তোলন হয়েছে বিষয়টি জানতে চাইলে পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক রোস্তম আলী জানান, ব্যাংকে রক্ষিত কারো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে হলে উচ্চ আদালতের অনুমতি লাগে। আমরা উচ্চ আদালতে বিষয়টি অবহিত করেছি। আদালত থেকে অনুমতি পেলে ডাচ বাংলা ব্যাংকে নোটিশ পাঠাবো।
আনন্দবাজার/শাহী/মতিন