ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাঙ্গুনিয়ায় ৯০ ভাগ ইটভাটাই অবৈধ

রাঙ্গুনিয়া ৯০ ভাগ ইটভাটাই অবৈধ

চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা এখন ইটভাটার নগরীতে পরিণত হয়েছে। গড়ে উঠেছে ৯০ ভাগ অবৈধ ইটভাটা। নেই কোন বৈধ কাগজপত্র। প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরকে ম্যানেজ করে ইটভাটা পরিচালনা করছেন বলে জানান উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নে অবৈধভাবে চলতে থাকা ইটভাটার মালিক পক্ষের একজন।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১২টি ইউনিয়নেই রয়েছে ১৫০ ইটভাটা। কেবলমাত্র রাজানগর, দক্ষিণ রাজানগর এবং ইসলামপুর ইউনিয়নে রয়েছে ১১৩টি ইটভাটা। এর বেশিরভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে আবার পাহাড়ের পাদদেশে। তৎমধ্যে ৯০ শতাংশ ইটভাটায় নেই কোন বৈধ কাগজপত্র। এসব ইটাভাটায় বছরে পুড়ছে শতকোটি টাকার কাঠ। ইট তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য যত্রতত্র ভাবে মাটি কাটায় বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার সংরক্ষিত বন ও পাহাড়। এতে করে প্রাকৃতিক বনজ সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি ক্রমশ ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশের।

জানা গেছে, রাঙ্গুনিয়ায় শতাধিক ইটভাটা থাকলেও ৯০ ভাগ ইটভাটার মালিকদের কাছে নেই কোন বৈধ কাগজপত্র। এই অবৈধ ইটভাটা চালাতে মালিক পক্ষ সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বন বিভাগ, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, রেঞ্জ, বনবিট অফিস, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের ম্যানেজ করে সংরক্ষিত ও অশ্রেনীভুক্ত বন থেকে শতকোটি টাকার কাঠ কেটে পুড়ানো হচ্ছে জ্বালানী হিসেবে। সেসাথে নির্বিচারে পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে ইট তৈরীর কাজে।

উপজেলার বিভিন্ন ভাটা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় দেড়’শ ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রায় সব ভাটাই কয়লার পরিবর্তে অবৈধ জ্বালানি কাঠের ব্যবহার চলছে অবাধে। প্রত্যেক ভাটায় মজুদ রাখা আছে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কাঠ।

এদিকে অবাধে কাঠ পোড়ানোর উৎসবকে কেন্দ্র করে রাঙ্গুনিয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পাচারকারী ও চোরাই জ্বালানি কাঠের ব্যবসা। সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং সামাজিক বনায়নের বাগান উজাড় করে তৈরি করা হচ্ছে জ্বালানি কাঠ। অসাধু বন কর্মকর্তদের যোগসাজশে বিভিন্নস্থানে ডিপোতে মজুদ করে সেখান থেকে কাঠ যাচ্ছে ইটের ভাটায়। বিশেষ করে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী রেঞ্জের আড়াছড়ি, চিৎমরম, রামপাহাড়, সীতাপাহাড় এবং কাপ্তাই পাল্পউড বন বিভাগের রাজস্থলী, বান্দরবান, বনাঞ্চলের বাগানের বৃক্ষ জ্বালানি কাঠ করে সরফভাটার মিরেরখীল, ভুমিরখীল, রাইখালী, কোদালা, পুর্ব কোদালা, শিলক থেকে কাঠ এসে কর্ণফুলী নদীর তীরে এবং চন্দ্রঘোনা দেওয়ানজীরহাট খেয়াঘাটের নিকটে প্রকাশ্যে মজুদ করে গড়ে তোলা হয়েছে চোরাই জ্বালানি কাঠের বড় বড় ডিপো। এই ডিপোগুলো থেকে চাঁদের গাড়িযোগে চোরাই জ্বালানি কাঠ পাচার করা হচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায়।

অন্যদিকে প্রতিটি ইটভাটায় যে পরিমাণ ইট উৎপাদন হয়, সে অনুযায়ী সরকারি ভ্যাট পরিশোধ হচ্ছে না। ফলে সরকার একদিকে হারাচ্ছে বিশাল অংকের রাজস্ব অন্যদিকে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ। বিশেষ করে উপজেলা ১ নং রাজানগর, দক্ষিণ রাজানগর, ইসলামপুর, হোচনাবাদের নিশ্চিন্তাপুর, লালানগরের শনখোলা বিল, চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নে ইটভাটা স্থাপনের নীতিমালা না মেনে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও পাহাড়বেষ্টিত এলাকায় ভাটা স্থাপন করে সরকারি ও ব্যাক্তি মালিকানাধীন সংরক্ষিত পাহাড় থেকে স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটায়। ফলে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অবৈধভাবে গড়ে উঠা এসব ভাটার কালো বিষাক্ত ধোয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। এমনকি ইটভাটার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় অনেকে বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্রে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, উপজেলার অধিকাংশ ইটভাটা অবৈধ। আর এসব অবৈধ ইটভাটায় বিনা বাধায় ইট পোড়ানোর লক্ষ্যে প্রশাসন, বন অফিস, সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করার জন্যে ইটভাটা সমিতির নাম দিয়ে সভাপতি ও সেক্রেটারির নেতৃত্বে প্রতি ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে ৫০- ১ লক্ষ টাকা করে প্রায় ১ থেকে দেড় কোটি টাকা সংগ্রহ করে ঘাটে ঘাটে বিলাচ্ছে। ফলে প্রশাসনসহ সবাই এসব দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছূক) ইটভাটার এক মালিক বলেন, ‘প্রশাসন, বন বিভাগ, পুলিশ ফাঁড়ি, বিট অফিস, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ সকল দপ্তরে ক্যাটাগরিনুযায়ী স্তরে স্তরে ম্যানেজ করে ইটভাটা পরিচালনা করছি। এসব পত্রিকায় লিখলে একটি ভাটাও বন্ধ হবে না। পত্রিকায় লেখালেখি করলে প্রশাসন ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে কিছু জরিমানা আদায় করবে। এছাড়া কোনো ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার নজির নেই।’

ইসলামপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল খায়ের বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা স্থাপন ও ট্রাকযোগে ইট পরিবহনের কারণে ধলায় পরিবেশ বিষন্ন হয়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীরা ইটভাটার ধুয়া ও ধুলাবালির কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রশাসন এই অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ না করলে অচিরেই মারাত্বক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ ইট ভাটার সংখ্যা ও সঠিক তথ্য তার অফিসে নেই। ইটভাটার অনুমতি ও ছাড়পত্র দেয়া জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এখতিয়ার। তবে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইটের ভাটায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান অব্যাহত আছে। এবং অবৈধ ইটভাটা বন্ধে শীঘ্রই অভিযান চালানো হবে বলে তিনি জানান।’

আনন্দবাজার/শাহী/মতিন

সংবাদটি শেয়ার করুন