ঢাকা | বৃহস্পতিবার
১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দপুরে বিলুপ্ত প্রায় আগুন চোখা মাছ পুনরুদ্ধার

দেশের মাছের উৎসগুলো হতে তিন দশক আগে প্রায় হারিয়ে যাওয়া আগুন চোখা মাছটি নীলফামারীর সৈয়দপুর স্বাদু পানি মৎস্য গবেষণা উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিকরা পুনরুদ্ধার করেছেন। তারা এ মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করে দেশের বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতীকে আবারও সমৃদ্ধ করলেন।

জানা যায়, ৮০ দশকে চাষাবাদি জমিতে যথেচ্ছা কীটনাশকের ব্যবহার, কলকারখানার বর্জ্যে নদ-নদী, খাল-বিল দুষনসহ অব্যবস্থাপনায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় মাছচাষ। এরপর ১৯৮৮ সালের বৃহৎ বন্যায় মাছের উৎসগুলো প্লাবিত হয়। এতে কীটনাশকময় চাষাবাদি জমি এবং দুষনযুক্ত পানির উৎসে ছড়িয়ে যায় মাছ। তারা পতিত হয় বিষাক্ত ও প্রতিকুল পরিবেশে।

এতে মাছের দৈহিক বৃদ্ধিব্যহতসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। মাছের শরীরে পঁচন রোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মহামারি। এভাবে বছরের পর বছর মাছের দেহে পঁচনসহ নানা রোগে দেশি বিভিন্ন প্রজাতীর মাছ প্রায় হারিয়ে যায় গ্রামবাংলার মাছের উৎস্য থেকে।

৯০ দশকে কমে আসে মাছের বিভিন্ন প্রজাতী। স্থানীয় কোন নদী-নালা, জলাশয়ে অনেক মাছ দেখা যায় না। দু:ষ্প্রাপ্য এ সকল বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতিদের মধ্যে আগুন চোখা বা আঙ্গুস অন্যতম। এ মাছটি ছিল রংপুর অঞ্চলের মানুষের অন্যতম পছন্দের মাছ। তবে বাংলাদেশ স্বাদু পানি মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মাছটিকে হারিয়ে যেতে দিল না। তারা সুপরিকল্পিত গবেষনার মাধ্যমে আবারও এর প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল আবিস্কার করে সহজলভ্য করলেন মাছটিকে।

সৈয়দপুর স্বাদু পানি মৎস্য গবেষনা উপকেন্দ্র সুত্র মতে, ২০১৮ সালে আগুন চোখা মাছটিকে পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছর এ অফিসের সংশ্লিষ্টরা তিস্তা, চিকলী ও আত্রাই নদী থেকে এ মাছের ১৫ থেকে ২০ গ্রাম ওজনের পোনা সংগ্রহের পর এ উপকেন্দ্রের পুকুরে প্রতিপালনে ব্রুড বা প্রজননের জন্য পরিপক্ব করা হয়। এরপর চলতি প্রজনন মৌসুমে হরমোন ইঞ্জেকশন প্রদানের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজননে পোনা উৎপাদনে সফলতা আসে।

সৈয়দপুর স্বাদু পানি মৎস্য উপকেন্দ্রের এ মাছ নিয়ে গবেষনায় ছিলেন, উপ-কেন্দ্রটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ খোন্দকার রশীদুল হাসান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শওকত আহমদ।

তারা জানান, এটা ছিল আমাদের টিম ওয়ার্ক। বিলুপ্ত প্রায় এ মাছের কৃত্রিম প্রজনন তুলনামূলকভাবে জটিল এবং নার্সারি ব্যবস্থাপনায় পোনার মৃত্যুর হার বেশি। এ নিয়ে আরো গবেষণা চলছে। তবে এ মাছের আদর্শ বসত স্থান হচ্ছে খরস্রোতা নদী ও প্রবাহমান জলাশয়।

অঞ্চলভেদে এ মাছের নাম হচ্ছে, আগুনচোখা, আঙ্গুস, আংরোট ও কারসা নামে পরিচিত। এ মাছটি উত্তরের নদ-নদী, খাল, বিল, পুকুর, হাওড়-বাওড় ছাড়াও বৃহত্তর সিলেটেও পাওয়া যেত। তবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে মাছটি প্রায় অচেনা। তবে চল্লিশর্ধো বয়সিরা এ মাছ সম্পর্কে ধারনা রেখেছেন।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শওকত আহমদ জানান, মিঠা পানির এ মাছটি ২০ থেকে ২২ সেন্টিমিটার লম্বা এবং সর্বোচ্চ ৩ শত গ্রাম ওজোনের হয়। তবে এ মাছটি ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম হলেই পরিপক্ব ও প্রজননক্ষম হয়ে থাকে। মে মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এর প্রজননকাল। তবে জুন-জুলাই সর্বোচ্চ প্রজননকাল বলে এ কেন্দ্রের মৎস্য বৈজ্ঞানিকরা উল্লেখ করেন।

একটি আগুন চোখা স্ত্রী মাছ ২০ থেকে ৫০ হাজার ডিমের ধারণক্ষমতা রয়েছে। একই বয়সের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আগুন চোখা মাছের চেয়ে আকারে বড় হয় স্ত্রী মাছ। বর্তমানে এর বাজারমূল্য ৫ থেকে ৬ শত টাকা কেজি। এর উভয় পাশে লেজ পর্যন্ত কালো একটি সমান্তরাল রেখা। অনেকটা দেখতে আঞ্চলিক ভাগনা বাটা মাছের আকৃতি। তবে এটা বাটা থেকে ভিন্ন প্রজাতির।

সৈয়দপুর স্বাদু পানির মৎস্য গবেষনা উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডঃ খোন্দকার রশীদুল হাসান বলেন, সরকারি নির্দেশনায় দেশি মাছ সংরক্ষণ ও বিপন্ন মাছ পুনরুদ্ধারে এ কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া উর্ধ্বত্বন সহায়তা ও পরিকল্পিত ভাবেই ইনস্টিটিউটে গবেষণা চলছে। এতে এ গবেষনা উপকেন্দ্রসহ অন্যান্য কেন্দ্র মিলে ২৩ প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় দেশি জাতের ছোট মাছের প্রজনন ও চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে দেশব্যাপী দেশি মাছের উৎপাদন গত এক যুগে চার গুণ বেড়েছে। যা ২ লাখ একচল্লিশ হাজার মেট্রিক টনে (২০১৭-১৮) উন্নীত হয়েছে।

আর সৈয়দপুর গবেষনা কেন্দ্র থেকে টেংরা, গুতুম, কাকিলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে। এছাড়া রানি মাছ, পিয়ালী, বাতাসী, কাজলী, শালবাইম, ডেলা ও বোয়াল মাছ নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

আনন্দবাজার/শাহী/মনন

সংবাদটি শেয়ার করুন