শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নষ্ট মিটারে মাসে কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল!

নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবাঙ্গালী ক্যাম্পগুলোর বিদ্যুৎ বিল নিয়ে শুরু হয়েছে তেলেসমাতি কারবার। নষ্ট মিটারে বিদ্যুত বিল বাবদ সরকারের কাছ থেকে প্রতিমাসে কোটি টাকা আদায়ের জন্য ভুয়া বিল প্রদান করা হচ্ছে। এতে সরকারি কোষাগারের বিশাল অংকের টাকা উত্তরাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরন কোম্পানী (নেসকো)’র পকেটস্থ হলেও নজর নেই কারও। জানা যায়, নেসকো সৈয়দপুর বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের অধীনে প্রায় ৫৭ হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছে। এ সকল গ্রাহকের মধ্যে আবাসিক, বাণিজ্যিক, উচ্চচাপ, মধ্যমচাপ, সেচ পাম্প স্কুল-কলেজ মসজিদ ও মাদ্রাসা। এ বিশাল গ্রাহকের জন্য প্রতিমাসে প্রায় ৮৫ লাখ থেকে ৯৫ লাখ ইউনিট আমদানি করা হয়। এখান থেকে কৌশলে অর্থের বিনিময়ে কতিপয় কর্মকর্তা গ্রাহকদের বিদ্যুৎ প্রদান করেন। এতে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ বিক্রির পর ঘাটতি দেখা দিলে ব্যাপক সিস্টেম লসের কবলে পরেন। তাই সিস্টেম লসের পরিমান কমাতে একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে সৈয়দপুরের ২৩টি অবাঙ্গালী ক্যাম্প।

স্থানিয় দপ্তরটির এলাকাভিক্তিক দায়িত্বে থাকা সহকারি ও উপ-সহকারি প্রকৌশলীরা মিটার ছাড়াই বেহিসেবি ইউনিট উপস্থাপন করে ক্যাম্পবাসিদের কাঁধে চাপিয়ে সরকারি দপ্তরে বিল প্রদান করছে। দির্ঘ দিন ধরে ক্যাম্পের নামে বিদ্যুতের পুকুর চুরির ঘটনা ঘটলেও কোন দায়বদ্ধতা নেই সরকারের দুর্যোগ ব্যাস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রনালয়ের। তারা নিরবেই নেসকো সৈয়দপুরের অনিয়ম মেনে নিচ্ছেন।

এ শহরের আটকেপড়া উর্দুভাষীদের (পাকিস্তানি) ২৪ টি ক্যাম্প রয়েছে। এগুলোতে প্রায় তিন হাজার ৯ শত ৩৭টি দুস্থ্য পরিবার বসবাস করে। তাদের অন্যান্য সুবিধার পাশাপাশি সরকার দুর্যোগ ব্যাস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিলও নেসকোকে পরিশোধ করেন। তবে কোন নজরদারি না থাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে নেসকো কোম্পানির সৈয়দপুর বিতরণ ও বিক্রয় কেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রকরা। তারা চলতি বছরের জুলাই মাসে এ সকল পরিবারের ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল প্রদান করেছে ৯৯ লাখ ২৫ হাজার ২৫৪ টাকার। পাশাপাশি পুর্বের বকেয়াসহ ৩৮ কোটি ১৬ লাখ ৫৩১ টাকা দেখানো হয়েছে মোট বকেয়া। এছাড়া চলতি বছরের আগষ্ট মাসে ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৯০ ইউনিট ব্যবহৃত দেখিয়ে বিল করা হয়েছে। যার মুল্য ১ কোটি ৯ হাজার ৬৬৫ টাকা।

আরও পড়ুনঃ  নেপালের বিদ্যুৎ কেনা হবে ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করে!

মিটার নষ্ট কিংবা না থাকলেও প্রতিমাসে ধাপে-ধাপে বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুৎ বিল। তবে এ ২৪ ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল পর্যালোচনায় অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। নেসকো কোম্পানি তাদের দেয়া চলতি বছরের জুলাই মাসের ২৪টি ক্যাম্পের ২৪টি বিলে মোট ব্যবহৃত ইউনিট ১৪ লাখ ৮৫ হাজার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে অবাঙ্গালী ক্যাম্প চামড়া গুদাম- (কনজুমার নং- ৫৬৩৪১০১৭) হিসাব নং২/ডি তে দেখানো হয়েছে বর্তমান রিডিং ৬৬ হাজার ৪ শত ৭০। পুর্বের রিডিং ২৬ হাজার ৪ শত ৭০। এতে বর্তমান ব্যবহৃত ইউনিট দাড়ায় ৪০ হাজার। তবে বিলে ২০ হাজার বৃদ্ধি করে লেখা হয়েছে ৬০ হাজার ইউনিট। একই ঘটনা ঘটানো হয়েছে চামড়া গুদাম ক্যাম্প-৫ (কনজুমার নং- ৫৬৩৪১০২১) ক্যাম্পে। এ ক্যাম্পে বর্তমান রিডিং ৮৫ হাজার ৯ শত ৩৫। পুর্বের রিডিং ৫১ হাজার ৯শত ৩৫ ইউনিট। এতে ব্যবহৃত ইউনিট হওয়ার কথা ছিল ৩৪ হাজার। তবে এ বিলে ৩২ হাজার ইউনিট বাড়িয়ে ৬৬ হাজার ব্যবহৃত ইউনিট দেখানো হয়েছে।

মিটার না থাকলেও এভাবে ইচ্ছে ভুলে ৩০ হাজার বেশি ইউনিট বিল করা হয়েছে অবাঙ্গালী ক্যাম্প-২ (কনজুমার নং-৫৬৩৪১০৪০) তে। ধর্মশালা ক্যাম্প (কনজুমার নং- ৫৬৩৪০৯৫১) ২৮ হাজার, গোলাাহাট জয়নাল ওয়েল মিল ক্যাম্পে (কনজুমার নং-৫৬৩৪১২৬৭) ৩০ হাজার, পৌরসভা পানির পাম্প ক্যাম্পে (কনজুমার নং-৫৬৩৪১০৬১) ১৩ হাজার, রেল ম্যাচ ক্যাম্পে (কনজুমার নং-৫৬৩৪০৯৭৯) ২৮ হাজার ইউনিট, হাতিখানা ক্যাম্পে (কনজুমার নং-৫৬৩৪৩৫৪৫) ৩৪ হাজার, হাতিখানা ক্যাম্প-২ (কনজুমার নং- ৫৬৩৪৩৫৫১) তে ২০ হাজার, হাতিখানা ক্যাম্প-৩ (কনজুমার নং- ৫৬৩৪৩৫৬৪) তে ২৮ হাজার, নয়াটোলা ক্যাম্প-২২/ডি (কনজুমার নং- ৫৬৩৪২১১৯) তে ২২ হাজার ইউনিট মিলে লাখ ২ লাখ ৮৫ হাজার ইউনিট বেশি দেখানো হয়েছে।

লেখার ভুলে সরকারি দপ্তরকে এ বিশাল ইউনিটের বিলও পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া যেখানে মিটার নেই সেখানে কিভাবে গ্রাহকের নাম, ঠিকানা, হিসাব নং, লোড, মিটার নং, পূর্ববর্তী রিডিং, বর্তমান রিডিং, ব্যবহ্নত ইউনিট, পুর্বের বকেয়া, মোট বকেয়া লেখা সংবলিত বিদ্যুৎ বিল প্রদান করা হচ্ছে সরকারের দুর্যোগ ব্যাস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রনালয়ে তা কেউ বলতে পারছেনা।
সরেজমিনে ক্যাম্পগুলো ঘুরে পাওয়া তথ্য মতে, এ সকল পরিবারকে মাসে গড়ে আড়াই হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে এর বাস্তব চিত্র উল্টো। ঘিঞ্জি বসতির এ সকল পরিবার ৬৪ বর্গফুটের একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন এ সকল দুস্থ্য মানুষজন। সারা দিন বাহিরে কাজ শেষে ফেরার পর বিশ্রামের সময় একটি ফ্যান, একটি বাতি ও একটি টেলিভিশন কিংবা অনেকে বৈদুতিক চুলা ব্যবহার করলেও সংখ্যায় কম। রয়েছে কেবল একটি বাতি, একটি ফ্যান ও একটি টেলিভিশন। এ নিয়েই তারা ক্যাম্পে অনেকটা স্বাচ্ছন্দে জীবনতিবাহিত করছেন।

আরও পড়ুনঃ  কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত জিইর

এছাড়া বিদ্যুৎ অপচয়ের ফ্রিজ, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন কিংবা অন্যন্য বৈদ্যুতিক সামগ্রী নেই। বাঁশবাড়ি ক্যাম্প, মিস্ত্রিপাড়া ক্যাম্প, আমেরিকান ক্যাম্প, গোলাহাট হাট ক্যাম্প, হাতিখানা ক্যাম্প, আউট হাউস ক্যাম্প, ইসলামবাগ ক্যাম্প, শহীদ আজমল ক্যাম্প, রসুলপুর ক্যাম্প, ধর্মশালা ক্যাম্প, টিনাবাড়ি ক্যাম্প, বালু রেশ ক্যাম্প, বাঙ্গালীপুর ক্যাম্প, চামড়া গুদাম ক্যাম্প মিলে ২০ টিতে মিটার নেই। অনেক গুলোতে দৃশ্যমান থাকলেও তা নষ্ট। বাকি দুর্গামিল ক্যাম্প, ইসলাম বাগ ক্যাম্প ও রেলওয়ে মেস ক্যাম্প মিলে ৩ টিতে সচল মিটার রয়েছে। এরমধ্যে নিজ বাড়ি নামে একটি ক্যাম্প ১২ বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে। তার পরেও বিদ্যুৎ বিল দেখানো হয়েছে ক্যাম্পটির নামে।

এ নিয়ে কথা হয় সকল ক্যাম্পের সভাপতির সাথে। তারা বলেন, মিটারগুলো ২ বছর আগে শট সার্কিট কিংবা নানা কারণে পুড়ে গেছে। তৎক্ষনাত নেসকো সৈয়দপুর বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রকে অবহিত করা হয়েছে। তারা মিটার স্থাপনের কোন উদ্যোগ নেয়নি। তাই বাঁচার জন্য মিটার ছাড়াই প্রধান তারে সংযোগ নিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। হাতীখানা ৩টি ক্যাম্পের সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আমার সব ক্যাম্পের মিটার নষ্ট। ওভাবেই চলছে। বিষয়টি নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানালেও কোন লাভ হয়নি।

রসুলপুর ক্যাম্পের সভাপতি শাহাজাদা বলেন, আমাদের মিটারহীন তার দিয়ে বিদ্যুৎ অফিসের কর্মচারিরা বহিরাগত ৬০ পরিবারকে সংযোগ দিয়েছে। তারা কোন বিল না দিয়েও চলছে। একই কথা বলেন অন্যান্য ক্যাম্পের সভাপতি মোঃ ইলিয়াস, আলাউদ্দিন, মমতাজ, আজগর, শাহাজাদা, মাহাবুব, শাহাবুদ্দিন, মিষ্টার, গোলাম, বাট্টু, হামিদা খাতুন, জামাল উদ্দিন, আকবর হোসেন ও ওয়াকিল।

আরও পড়ুনঃ  পল্লবী থানায় বিস্ফোরণ, আহত ৪ পুলিশ

তবে দুর্গামিল ক্যাম্পের সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাদের মিটার সচল হলেও কখনই মিটার রিডার আসে না। এ সকল ক্যাম্পের বিলের পরিমান কত? বা কিভাবে পরিশোধ করা হয়। এর প্রক্রিয়া জানেন না কেউই। তাই এই ভুতুরে বিলের বিশাল অংক শুনে সকল ক্যাম্প সভাপতি বিস্ময় প্রকাশ করেন।

সৈয়দপুর উর্দুভাষী ক্যাম্পের উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মোঃ মাজিদ ইকবাল বলেন, আমাদের ক্যাম্পের একটি ঘরে একটি বাতি, একটি ফ্যান ও একটি টিভি চলে। এতে মাসে কখনই ৯৯ লাখ বা ১ কোটি টাকা বিল আসবেনা। এতে স্থানিয় নেসকো অফিস আমাদের ভাবমুর্তি সরকারের কাছে নষ্ট করছে। তারা ইচ্ছে মত বিল বানিয়ে সরকারের কাছে আদায় করছে। তাই এ ভুয়া বিদ্যুৎ বিল বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানান তিনি সরকারের উর্ধ্বত্বন কতৃপক্ষের কাছে।

নষ্ট মিটার বা মিটার ছাড়াই বিশাল এ বিদ্যুৎ বিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নেসকো সৈয়দপুর বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ তানজিমুল হক বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি তাচ্ছিল্যের সাথে বলেন, আপনার যা খুশি লিখতে পারেন। আমার বলার কিছুই নেই। এ নিয়ে প্রধান প্রকৌশলী বিতরণ অঞ্চল রংপুর মোঃ শাহাদাত হোসাইন সরকার বলেন, যেহেতু তারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। এতে বিল আসবেই। হয়ত কম বা বেশি হচ্ছে। তাই বিষয়টি দেখা হবে।

আনন্দবাজার/শাহী/মনন

সংবাদটি শেয়ার করুন