মোঃ সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তোমায় শুভকামনা জানাই আমার তারুণ্যের ভালোবাসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। একটি ইতিহাস একটি ঐতিহ্য জবি। নিরন্তর ছুটে চলা সে ইতিহাস হবে দীর্ঘতর।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি বিদ্যাপিঠ নয়, রয়েছে জবির ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরের সাথে মিশে আছে সোনালী অতীতের গৌরবময় স্মৃতি।ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় জবির নাম স্বগৌরবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাঙ্গালী ও বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অধিকার আদায়ে সোচ্চার সবসময়।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শূন্য থেকে পথচলা শুরু করেনি। এর রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের পরিবর্তিত রূপই আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৭২ সালে বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই বিদ্যাপীঠের নামকরণ করেন। ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাসের মাধ্যমে এটি পরিপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। সময়ের বিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়টি ২১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীর স্বপ্নের ক্যাম্পাসে রূপ নিয়েছে ।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নতুন হলেও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে সুদীর্ঘ দেড়শ বছরেরও পুরনো ইতিহাস। বাংলদেশের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুথান ও মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলনের ইতিহাসে জগন্নাথের অবদান কখনো অস্বীকার করার মতো নয়। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা শহরকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা।মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জগাবাবুর পাঠশালাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসিয়েছিল। তারা এই বিদ্যাপীঠে স্থাপিত ক্যাম্পে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণী, নারীদের ধরে এনে শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। বহু নিরীহ মানুষকেও হত্যা করা হয়েছিল এখানে। মুক্তিযুদ্ধের পর জগন্নাথে দুটি গণকবর আবিষ্কৃত হয়। মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথের ছাত্র-শিক্ষকদের অবদানও ছিল অবিস্মরণীয়। পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বহু ছাত্র-শিক্ষক যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জবির পরিমাপ করা যাবে না। জবিকে জ্ঞানের সূর্য বলা যায়। যা ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জ্ঞানের আলো যাচ্ছে। শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নিজেদের জানান দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে জবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু রয়েছে। অনেক আগেই ইউজিসির প্রতিবেদনে এ-গ্রেডভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। বিসিএসসহ সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
নানা প্রতিবন্ধকতার পরও বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য ও একাডেমিক শৃঙ্খলা এখন নতুন সৃষ্টি হওয়া যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রোল মডেল। সমসাময়িক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এত অল্প সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ আসনে বসতে পারেনি। একঝাঁক তরুণ মেধাবী শিক্ষক ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঞ্চিত গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ঝুড়ি সমৃদ্ধ শতাধিক পিএইচডি ডিগ্রিধারী অধ্যাপকের পদভারে মুখরিত এই বিদ্যাপীঠ, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের পছন্দের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। তাই প্রতিবছরই বাড়ছে ভর্তি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। প্রতিযোগিতার শতকরা হারে গত কয়েক বছর ধরে যা হার মানাচ্ছে দেশের অন্যসব নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেও।
আবাসন ও যানবাহন সমস্যায় জর্জরিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোবল, সাহস ও পরিশ্রমী মানসিকতা অবাক করে অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। ব্যয়বহুল ঢাকা শহরের মেস-বাসা-বাড়িতে কষ্টে দিন পার করা সত্ত্বেও তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে সর্বদা মাতিয়ে রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সক্রিয় অবস্থান জবিতে প্রাণের সঞ্চার নিয়ে আসে।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক বলয় গঠনে এসকল সংগঠনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও একাডেমিক পড়া-লেখার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চা ও দেশীয় সংস্কৃতি লালনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সহ-শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের বিকাশে এবং বিশ্ববিদ্যালয় আবহের পূর্ণতা পেতে ভূমিকা রাখে এসকল সংগঠনসমূহ। সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততায় ক্যাম্পাসে প্রাণের সঞ্চার হয়, পাশাপাশি একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠছে জবিতে। অন্য যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সক্রিয়তা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চোখে পড়ার মতো।আয়োজনের পসরা নিয়ে অবকাশ ভবনের সংগঠনগুলো নিয়মিত সরব থাকে, উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে থাকে প্রাঙ্গন।
এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে জবির সাথে মিশে থাকা অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা ঘুচে যাবে এমনটি ভেবে পুলকিতবোধ করছি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের উদ্বোধন আবাসিক তকমা লেপ্টে দিবে জবির নামের সাথে। আশাকরি হল চালু হলে পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক এক সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠবে জবিতে। হলটি শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বলয় তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করোনাকালীন সময়ে উৎসবমুখর না হলেও হল উদ্বোধন নিশ্চয় শিক্ষার্থীদের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বয়ে আনবে। কেরানীগঞ্জে জবির নতুন ক্যাম্পাস সর্বাধুনিক ক্যাম্পাস হবে বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন যা নিশ্চয় আমাদের জন্য বড় প্রাপ্তি। আশাকরি দ্রুত নতুন ক্যাম্পাসের কাজ সম্পন্ন হবে।
সংকট থেকে সম্ভাবনার সৃষ্টি। জয়তু জবি, এভাবে সংকট কেটে আলোর মুখ দেখবে প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা নক্ষত্রের মতো আলো ছড়াবে সে প্রত্যাশা রাখছি। জবির পথচলায় শুভকামনা নিরন্তর।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
আনন্দবাজার/শাহী/মাহাদী